মধ্যযুগে ভারতে বিভিন্ন সুফি সিলসিলা বা সম্প্রদায়ের পরিচয় দাও

ভূমিকা
খ্রিস্টীয় নবম-দশম শতকে হিন্দুধর্মে ভক্তিবাদের মতো ইসলাম ধর্মেও এক সংস্কারকামী উদার মতবাদের উদ্ভব ও প্রসার ঘটে। এই মতবাদ সুফিবাদ নামে পরিচিত। এই মতবাদের প্রবক্তারা সুফি বা তাসায়ুফ নামে পরিচিত। পরবর্তীকালে সুফিদের অনেক সিলসিলা বা সম্প্রদায় গড়ে ওঠে। অনেকে মনে করেন অষ্টম শতক নাগাদ সুফিরা ভারতে প্রবেশ করেছিল।
(1) চিস্তি সম্প্রদায় : আবুল ফজল লিখেছেন ভারতে সুফিদের চোদ্দোটি সম্প্রদায় প্রবেশ করেছিল। এদের মধ্যে চিস্তি ও সুহরাবর্দি সিলসিলা বা সম্প্রদায় ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী। ভারতে চিন্তি সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন খাজা মইনুদ্দিন চিস্তি। তিনি আজমিরে তাঁর মতাদর্শ প্রচার করেন। তাঁর অনাড়ম্বর জীবনযাপন এবং উদার মতবাদে আকৃষ্ট হয়ে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে। তাঁর শিষ্যদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বখতিয়ার কাকি, হামিদউদ্দিন নাগোরি প্রমুখ। তবে এই সম্প্রদায়ের সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় সন্ত বা সুফি সাধক ছিলেন শেখ নিজামউদ্দিন আউলিয়া। তিনি দিল্লিতে তাঁর দরগা প্রতিষ্ঠা করেন। এই সম্প্রদায়ের আর-এক জনপ্রিয় সাধক ছিলেন নাসিরুদ্দিন চিরাগ-ই-দিল্লি, যিনি ‘দিল্লির আলো’ নামে পরিচিত। চিস্তি সম্প্রদায়ের মূল আদর্শ ছিল ত্যাগ, বৈরাগ্য এবং সহজ-সরল জীবনযাত্রা।
(2) সুহরাবর্দি সম্প্রদায়: সুহরাবর্দি সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন শেখ শিহাবউদ্দিন সুরাবর্দি বা সুহরাবর্দি। তবে এই সম্প্রদায়কে শক্তিশালী ও সুসংহত করেন শেখ বাহাউদ্দিন জাকারিয়া। এই সম্প্রদায়ের আর-এক বিখ্যাত সন্ত হলেন হামিদউদ্দিন নাগোরি। চিস্তি সম্প্রদায়ের সঙ্গে এঁদের আদর্শ ও নীতিগত কিছু পার্থক্য ছিল। চিস্তিদের মতো এঁরা দরিদ্র জীবনযাপনের পক্ষপাতী ছিলেন না। এমনকি এঁরা রাজনীতিতে অংশগ্রহণ বা সরকারি পদও গ্রহণ করতেন। এই সম্প্রদায়ের প্রভাব মূলত পাঞ্জাব, মুলতান এবং পূর্ববঙ্গেই সীমাবদ্ধ ছিল।
(3) অন্যান্য সুফি সম্প্রদায় : উক্ত দুটি সম্প্রদায় ছাড়াও ভারতে আরও কয়েকটি সুফি সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের কথা জানা যায়। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ফিরদৌসি, কাদিরি বা কাদিরিয়া, নকশ্বন্দিয়া প্রভৃতি। তবে চিস্তি কিংবা সুহরাবর্দি সম্প্রদায়ের তুলনায় এঁদের প্রভাব ও জনপ্রিয়তা ছিল খুবই নগণ্য।
মূল্যায়ন
সুফিরা ছিলেন ইসলামের মরমিয়া সাধক। সুফিসন্তদের সামাজিক সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের বাণী সমাজের নীচ ও অবহেলিত শ্রেণির মানুষদের গভীরভাবে আকৃষ্ট করেছিল। মধ্যযুগে ভারতে বিভিন্ন ধর্ম ও নিম্ন সম্প্রদায়ের বহু মানুষ সুফি আদর্শে দীক্ষিত হয়েছিলেন।