ভ্রমণের মূল্য – মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা

- বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয়, অন্তর বিকশিত হয়, ব্যক্তির বদলে সমষ্টির যোগসূত্র।
- আত্মকেন্দ্রিকতার মোচন
- অচেনা মানুষ ও প্রকৃতির সান্নিধ্য
- আনন্দ
- বৈচিত্র্যের উপলব্ধি
- বহির্জগতের সঙ্গে বাস্তব যোগ
- ক্লান্তি দূর হয়
- মানসিক কৌতূহল ও জিজ্ঞাসার নিবৃত্তি ও অন্বেষণ
অজানাকে জানবার, অদেখাকে দেখবার আগ্রহ সব দেশের সব যুগের মানুষের মনেই থাকে। মুক্ত বিহঙ্গের মতো সে ছুটে যেতে চায় সংসারের সংকীর্ণ সীমানা ছাড়িয়ে অবাধ মুক্তির জন্য; প্রথমত, মনের পথ ধরে, তারপরে ভূগোল-ইতিহাসকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে ঘুরে আসা, সম্প্রদায়, ভাষা-নির্বিশেষে নানা মানুষের জীবনধারা। সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয়ের সুযোগ করে দেয় ভ্রমণ, তাদের বিচিত্র পোশাক-পরিচ্ছদ, খাদ্যাভ্যাস, ধর্মাচরণের সঙ্গে পরিচিত হওয়া যায়। বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যই যে মানবসভ্যতার মূলমন্ত্র তার ধারণা সম্ভব ভ্রমণের মাধ্যমেই। এর ফলে মানবমনের আত্মসম্প্রসারণ ঘটে, গড়ে ওঠে জাতীয়তাবোধ ও সমষ্টিগত – ঐক্যের ধারণা, যা ব্যক্তিকে তার আত্মকেন্দ্রিকতা থেকে মুক্তি দেয়।
মানুষের স্বভাবগত নেশাই হল ভ্রমণ। দেশ-দেশান্তরে ভ্রমণের মাধ্যমেই মানুষ চরিতার্থ করে তার মনের সৌন্দর্যপিপাসাকে। আধুনিক বিজ্ঞান মানুষকে অবাধ চলার সুযোগ করে দিয়েছে বলেই মানুষ আজ সহজেই পারে প্রকৃতি জগতের আনন্দলীলার বৈচিত্র উপভোগ করতে।
ভ্রমণ আজ শিক্ষার অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে। বাস্তবজ্ঞান এবং প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে ভ্রমণের গুরুত্ব অপরিসীম। দেশভ্রমণে যে শিক্ষা লাভ হয়, সারাজীবন গ্রন্থকীট হয়েও তা অর্জন করা সম্ভব হয় না। অর্থাৎ, বই পড়ে যে জ্ঞান অর্জন হয় তা পরোক্ষ কিন্তু ভ্রমণের মাধ্যমে পাওয়া যায় প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান।
দেশভ্রমণের মধ্য দিয়ে মানুষের পরিধি বিস্তৃত হয়। একই সঙ্গে মানুষ নিজেকে উন্নত করে তোলে। দেশভ্রমণ আমাদের শিক্ষা দেয় ভারতীয় সংস্কৃতি এবং ভারতীয় ঐতিহ্য বিষয়ে সচেতন হতে। সারা ভারতের নানা রাজ্য, নানা ভাষা, বিভিন্ন ধরনের মানুষের সংস্কৃতি ও ইতিহাসের মধ্যে যে বৈচিত্র এবং ঐক্যের অনুরণন ফুটে ওঠে, তা দেশের নানা স্থান ভ্রমণের মধ্য দিয়ে আমরা প্রত্যক্ষভাবে অনুধাবন করতে পারি। দেশভ্রমণ মানুষের জ্ঞান বিকাশ ঘটানোর সঙ্গে সঙ্গে মানব সংস্কৃতিকেও সমৃদ্ধ করে তোলে। ফা-হিয়েন, হিউয়েন সাং, আলবেরুনি, ইবন বতুতা প্রমুখদের রচনা তৎকালীন ইতিহাসকে আমাদের সামনে মূর্ত করে তোলে। শুধুমাত্র ইতিহাসের উপাদান হিসাবে নয়, ভ্রমণসাহিত্য সাহিত্যের একটি বিশিষ্ট ধারা হিসাবেও জনপ্রিয়। ভ্রমণপিপাসু মানুষের কাছে তা ঘরে বসে প্রকৃতির সান্নিধ্য উপভোগ করার মাধ্যম।
ভ্রমণ অনাবিল আনন্দের উৎস। শরীরের পুষ্টি জোগায় খাদ্য, তেমনি মানুষের মানসিক ক্ষুধার নিবৃত্তি ঘটে দেশভ্রমণে। ভ্রমণ একই সঙ্গে শারীরিক মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়।
ভ্রমণ উদ্দেশ্য বহুবিধ। কেউ শিক্ষামূলক উদ্দেশ্যে দেশভ্রমণ করে, কেউ-বা নিছক বিনোদনের জন্য, আবার কারোর উদ্দেশ্য তীর্থ দর্শন, কেউ আবার জিজ্ঞাসু মনের তাড়না দূর করার জন্য ভ্রমণের উদ্দেশ্যে বের হন। দৈনন্দিন জীবনের একঘেয়েমি মানুষকে ক্লান্ত করে তোলে। তাই মানুষ একটু সুযোগ পেলে ভ্রমণে বেরিয়ে পড়ে সেই ক্লান্তি দূর করার জন্য। এ ছাড়াও রয়েছে মানুষের চিরন্তন কৌতূহল। সেই সব কৌতূহল নিবৃত্তি কিংবা নিজের জ্ঞানের সীমিত ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করার জন্য ভ্রমণের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
মানুষ আজ পারস্পরিক শক্তির প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ। সুখ, বৈভব, উন্নতির পিছনে ধাবমান মানুষের নিঃসঙ্গতা, একাকিত্ব আজ অন্যতম সংকট হয়ে দেখা দিয়েছে। এই একাকিত্বকে দূর করার জন্য দেশভ্রমণ এক অন্যতম উপায় হয়ে উঠতে পারে।
ভ্রমণে প্রাণের সঙ্গে প্রাণের মিলন ঘটে। নতুন জীবনদৃষ্টি আর জীবনীশক্তি দেয় ভ্রমণ। ভ্রমণকে কেন্দ্র করে নানা দেশে আজ গড়ে উঠেছে পর্যটনশিল্প। এতে বৈদেশিক মুদ্রাও দেশের ঘরে আসে। এই সূত্রে বহু মানুষ বেঁচে থাকার মতো কাজও খুঁজে পায়। তাই একালে দেশভ্রমণ হয়ে উঠেছে জীবিকা অর্জনের হাতিয়ার। ভ্রমণের এই পিপাসা, আনন্দ আর অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ে আত্মকেন্দ্রিকতার মোচন ঘটে বলেই ভ্রমণ আজ আধুনিক জীবনে অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।