ভারতের দেশপ্রেমের ঐতিহ্য – মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা

- দেশ কেবল নির্দিষ্ট ভূখণ্ড নয়
- বৈচিত্র্যে ঐক্য
- স্বাধীনতা আন্দোলন ও দেশপ্রেম
- বিশ্বমৈত্রী ও দেশপ্রেম
- দেশপ্রেম ও বর্তমান ভারতবাসী
“জননী জন্মভূমিশ্চ সর্গাদপী গরিয়সী”- অর্থাৎ জননী ও জন্মভূমি সর্গের থেকেও মহান। মায়ের প্রতি যেমন, ঠিক তেমনই স্বদেশ অর্থাৎ জন্মভূমির প্রতিও মানুষ নারীর টান অনুভব করে। নিজের দেশ তা যেমনই হোক-না কেন, তা আমাদের সকলের কাছে অত্যন্ত প্রিয়। এমন অনুভব থেকেই কবি দ্বিজেন্দ্র লাল রায় লিখেছিলেন- “এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি।” তবে দেশ বলতে যে শুধু একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডকেই বোঝায় তা নয়। দেশ বলতে প্রধানত ওই নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষজনদের বোঝায়। একটি দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং জনসাধারণের প্রতি ওই দেশের মানুষের যে ঐকান্তিক টান, তাই হল দেশপ্রেম।
বিবিধের মাঝে মহান মিলনের সাধনায় ভারতবর্ষের ঐতিহ্য। আর্য-অনার্য শক্-হুন, পাঠান কিংবা মোগল কোনো মানুষ বা জাতি এখানকার মাটির সংস্পর্শে এসে তার স্বতন্ত্রতা বজায় রাখতে পারেনি। কবির ভাষায় বলা যায়- “দেবে আর নিবে মিলাবে-মিলিবে, যাবে না ফিরে, এই ভারতের মহামানবের সাগর তীরে।” তাই এখানকার আলো-বাতাস আর মাটির মধ্যেই এমন এক জাদুর স্পর্শ আছে। যা এদেশের সন্তান বা অতিথিকেও পরম মমতায় আকৃষ্ট করে। এই অদৃশ্য সুতোর মায়া ডোরে বাঁধা পরে সবাই। ভাষা ধর্ম জাতিগত বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র বজায় রেখেও এদেশের সকল মানুষ পরিচিত হয় ভারতীয় রূপে। তাই ভারতের অন্তরের বাণী হল বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য।
দেশপ্রেমের সংহত ও সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটেছিল পরাধীন ভারতের স্বাধীনতা অন্দোলনের পর্বে। গানে-গল্পে-কবিতায় স্ব-দেশিকতা ও স্বাজাত্যবোধের বৈচিত্রপূর্ণ প্রকাশ ঘটেছিল এই সময়। স্বদেশমাতার মুক্তির স্বপ্নে প্রাণিত হয়ে শতসহস্র তরুণ-তরুণী আত্মদানে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। তাদের দেশপ্রেমের সাহস নিষ্ঠা ও আদর্শে ভর করেই একদিন পরাধীন ভারত মুক্ত হয়েছিল আর স্বাধীন ভারত তার সমন্বয়ী চরিত্রটিকে অটুট রেখে; সমগ্র বিশ্বের কাছে স্বাধীনতা মৈত্রী এবং ধর্মনিরপেক্ষতার সুদূর চরিত্রটিকে মেলে ধরেছে। একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে এসে ভারতের জাতীয় সংহতি কিন্তু কিছুটা শিথিল হয়ে পরেছে। এর প্রধান কারণ হল ধর্মীয় সংকীর্ণতা। সার্থপর এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন কিছু ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক নেতা দেশবাসীর মনে মৌলবাদী মানসিকতা জাগিয়ে তুলতে সচেষ্ট হচ্ছে। ফলে দেশে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ বৃদ্ধি পাচ্ছে। দ্বিতীয় কারণ হল ভাষার সমস্যা। বহু ভাষার এই দেশে কয়েকশো ভাষার মধ্যে মাত্র ২২টি সরকারি ভাষা হিসাবে স্বিকৃতি পেয়েছে। এদের মধ্যে ইংরেজি এবং হিন্দি এই ভাষা দুটি আন্তঃরাজ্য যোগাযোগের ভাষা হিসাবে স্থিরীকৃত হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরেই হিন্দিকে অহিন্দিভাষী রাজ্যগুলির উপরও চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলেছে। ফলে অহিন্দিভাষী রাজ্যগুলিতে তীব্র অসন্তোষের সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে উগ্র প্রাদেশিকতা। এ ছাড়াও বর্ণান্ধতা, কুসংস্কার প্রভৃতিও জাতীয় সংহতিকে ব্যাহত করছে। এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে জনসাধারণ ও সরকারকে দেখতে হবে দেশের প্রতিটি মানুষ যেন অন্নবস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষার যথাযথ সুযোগ পায়। কোনো ভারতবাসী যেন তার নিজস্ব ভাষা, ধর্ম এবং সংস্কৃতির চর্চার সুযোগ থেকে বঞ্চিত না হয়। দেশপ্রেম মানুষের মহৎ গুণ হলেও সংকীর্ণ এবং নির্দেশপরায়ণ দেশপ্রেম পৃথিবীর বুকে গভীর সংকট নিয়ে আসে। এই ধরনের উগ্র দেশপ্রেম বিশ্বপ্রেমের অন্তরায়। মানুষ যদি নিজের দেশকে ভালোবাসার সঙ্গে সঙ্গে অন্য দেশের প্রতিও সশ্রদ্ধ মনোভাব পোষণ করে তবেই তা বিশ্বপ্রেমের সহায়ক হয়। মানুষকে যদি আমরা জাতি ধর্ম ভাষা রাষ্ট্রের মধ্যে আবদ্ধ না-রেখে শুধু মানুষ হিসেবেই তাকে বিচার করি। তবেই হতে পারি বিশ্বপ্রেমী। কবি সত্যেন্দ্রনাথ বলেছেন- “জগৎ জুড়িয়া আছে এক জাতি, সে জাতির নাম মনুষ্য জাতি। এক পৃথিবীর স্তনে লালিত, একই রবিশশী আমাদের সাথি। এমন ভাবনাই হল বিশ্বমৈত্রী। এই ভাবনায় বলে যে সমগ্র পৃথিবী হল আমার দেশ। আমি সমগ্র মানবজাতির অংশ। সংকীর্ণ দেশপ্রেম নয় বিশ্বমৈত্রীস্নাত দেশপ্রেমই আমাদের কাম্য।
স্বদেশপ্রেম ও বিশ্বপ্রেম এক অখণ্ড উপলব্ধিরই অভিন্ন সত্তা। ঋগ্বেদ-এ প্রার্থনা করে ছিল- “তোমরা সংযুক্ত হও, একবিদ বাক্য প্রয়োগ করো।” এটাই কালের পর কাল মৈত্রীর বাণী হয়েছে। মানুষে মানুষে সম্প্রীতির কথা রচিত হয়েছে। ধনী হোক, দরিদ্র হোক, ব্রাহ্মণ বৈশ্য শুদ্র, ক্ষত্রিয় যে-কোনো বর্ণেরই হোক মানুষ হিসাবে সকলেই এক ও অভিন্ন। বিদ্রোহী কবি তাই গাইলেন “মোরা একই বৃন্তে দুইটি কুসুম-হিন্দু মুসলমান”। বিশ্বকবী ভারততীর্থের জয়গান রচনা করলেন। ভারতের প্রতিটি আনাচেকানাচে ভাষা সংস্কৃতি সাহিত্যে, ছবি-ভাস্কর্য-স্থাপত্যে, গানে-নাটকে-নৃত্যে আলোকিত হয়ে উঠেছে মানুষের ধর্ম, মানবের কল্যাণ। এই ধারাবাহিকতা চলতেই থাকবে, কারণ দেশটার নাম যে ভারতবর্ষ।
দেশপ্রেম আমাদের মনের জলন্ত অগ্নিশিখা, সেই অনলে অন্তরের সব পাপবোধকে আহুতি দানেই আমাদের জীবন পরিশুদ্ধ হয়। এক মহৎ চেতনার বিভায় মানবজন্ম হয় ভাস্বর। নিজের স্বার্থ পরিহার করে দেশের স্বার্থ রক্ষা করতে হবে। তবেই দেশের যথার্থ উন্নতি সাধন ঘটবে। দেশকে ভালোবেসে স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন- “ভারতের মৃত্তিকা আমার সর্গ ভারতের কল্যাণ আমার কল্যাণ”-ভারতবাসী যে-দিন স্বামীজির এই বাণীর মর্ম উপলব্ধি করবে। সেই দিনই জাতীয় অগ্রগতি সম্ভবপর হবে।