ভাব সম্মিলন কবিতার প্রশ্ন উত্তর Class 11

Table of Contents

ভাব সম্মিলন কবিতার প্রশ্ন উত্তর Class 11

ভাব সম্মিলন কবিতার প্রশ্ন উত্তর
ভাব সম্মিলন কবিতার প্রশ্ন উত্তর

ভাবসম্মিলন বলতে কী বোঝো? আলোচ্য পদটিতে শ্রীরাধার আনন্দের যে রূপ প্রকাশিত হয়েছে তা নিজের ভাষায় আলোচনা করো।

ভাবসম্মিলনের সংজ্ঞার্থ: শ্রীকৃষ্ণ চিরতরে মথুরা গমনের পর বিরহকাতরা শ্রীরাধা কল্পনায় কৃষ্ণের সঙ্গে মানস মিলনসুখ অনুভব করেছেন। বৈষ্ণব রসপর্যায়ে এর নামই ভাবসম্মিলন। ভারতীয় সাহিত্যে ট্র্যাজেডির কোনো স্থান নেই। কাজেই, কৃষ্ণের মথুরা যাত্রার পর যে অশেষ অফুরন্ত বিরহের সঞ্চার ঘটেছিল শ্রীরাধার হৃদয়ে, তা শিল্প সংগত নয়। তাই বাস্তবে সম্ভব না হলেও ভাবের জগতে তাদের মিলন ঘটানো হয়। কারণ, বাস্তবিকই, ভাবের জগতে বিরহ নেই। তাই এখানে রাধাকৃষ্ণের নিত্য মিলন। এটাই ভাবসম্মিলন।

শ্রীরাধার আনন্দঃ বিদ্যাপতি বিরচিত ‘ভাব সম্মিলন’ নামাঙ্কিত নাম-শীর্ষক পর্যায়ের কবিতাটিতে অরূপ লীলারস সম্ভোগের জন্য শ্রীরাধার হৃদয় প্রস্তুত। শুধু তাই নয়, এই আনন্দের উচ্ছ্বসিত আবেগ যদি অপরের সঙ্গে ভাগ করে না দেওয়া যায়, তাহলে তা সম্পূর্ণ হয় না। তাই তিনি সখিকে ডেকে বলেছেন, “কি কহব রে সখি আনন্দ ওর।/চিরদিনে মাধব মন্দিরে মোর।।” দীর্ঘ বিরহের অশ্রুস্নানের পর আকস্মিক আনন্দঘন মুহূর্তের আবির্ভাব ঘটেছে তাঁর জীবনে। তাই তিনি বলেছেন, চাঁদ সুন্দর, কিন্তু তা অধরা। আবার, কৃষ্ণও সুন্দর, তাই তিনিও অধরা। কিন্তু মন কৃষ্ণকে স্পর্শ করতে পারে। প্রিয়তমের মুখদর্শন করে এই তুলনাহীন সুখানুভূতি শ্রীরাধাকে কমনীয় করে তুলেছে। এখানে শ্রীরাধার চিন্তাচেতনা অনেকটাই আধ্যাত্মিকতার জগৎ ছেড়ে লৌকিক। শ্রীরাধা মনে করেছেন যে, তিনি যদি প্রভূত পরিমাণ অর্থ পেতেন, তাহলে উপার্জনের জন্য তাঁর প্রিয়তমকে দূরদেশে পাঠাতেন না। কৃষ্ণের এই স্বরূপ তিনি তাঁর হৃদয় থেকে অনুভব করেছেনি। এই কৃষ্ণ তাঁর কাছে শীতের ওড়নার মতো বিপদহন্তা, আবার গ্রীষ্মের বাতাসের মতো অসহনীয়। একদিকে কৃষ্ণ তাঁর কাছে বর্ষার ছাতার মতো অপরিহার্য, আবার তিনি অকুল সমুদ্রে পথপ্রদর্শকের মতো নৌকা। এইভাবে সমগ্র পদের প্রতিটি ছত্রে ছত্রে লেগে রয়েছে কৃষ্ণের সঙ্গে শ্রীরাধার মিলনের সুতৃপ্ত আবেগের উচ্ছ্বাস, আনন্দ ও সন্তুষ্টি। যেহেতু ভাবের ঘরে এই মিলন ঘটেছে, তাই সে মিলন ভেঙে যাওয়ারও নয়। তাই এই আনন্দানুভূতি চির-অমলিন অনিঃশেষ।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘বিদ্যাপতি সুখের কবি।’ -আলোচ্য পদটি অবলম্বনে বিশ্বকবির এই মন্তব্যের যথার্থতা প্রমাণ করো।

মন্তব্যের যথার্থতা প্রমাণ: বিদ্যাপতি বিশ্বাস করতেন, মিলনে সুখ, আর বিরহে দুঃখ। তাই কৃষ্ণ যখন মথুরা চলে গেলেন, আর বৃন্দাবনে ফিরলেন না কখনও, তখন রাধার জন্য বিরহগাথা রচনা ছাড়া আর উপায় ছিল না। কিন্তু ভারতীয় সাহিত্য বিরহ দিয়ে শেষ হয় না। তাই ভাবের মধ্য দিয়ে মিলন ঘটানো হল উভয়ের। কৃষ্ণ এলেন রাধার ঘরে, আনন্দ এল ফিরে। মনের কল্পনা যদি ভাবনা এনে দেয়, আর ভাবনা যখন কল্পনার দোসর হয়, তখন নিঃসঙ্গতা দূরীভূত হয়ে যায়। বিরহ যন্ত্রণাও তখন আর থাকে না। অনির্বচনীয় এক সুখানুভূতি জাগে মনে। তাই বিদ্যাপতি ‘সুখের কবি’।

বিদ্যাপতি রচিত ‘ভাব সম্মিলন’ পদে বৈষ্ণব রসতত্ত্ব কীভাবে ধরা পড়েছে, তা আলোচনা করো।

‘ভাব সম্মিলন’-এর পদে বৈষ্ণব রসতত্ত্ব : বৈষ্ণব রসতত্ত্ব অনুযায়ী শ্রীকৃষ্ণ হলেন ভগবান, আর শ্রীরাধা হলেন তাঁরই লীলা প্রকাশক শক্তি। ভক্ত যখন শ্রীরাধিকার মতো রাগানুগা ভক্তির পর্যায়ে উন্নীত হতে পারবে, একমাত্র তখনই তাঁর পক্ষে ঈশ্বর সুখ লাভ করা সম্ভব।

আলোচ্য পদে ভাবের জগতে রাধাকৃষ্ণের মিলনের কথা বলে বিদ্যাপতি প্রকৃতপক্ষে সেই রাগানুগা ভক্তির কথাই বলেছেন। শাস্ত্রীয় বিধিবিধান, পূজা-উপাসনার ঊর্ধ্বে উঠে শুধুমাত্র ঈশ্বর সুখ অনুভবের জন্য যে ভক্তি, তাকেই রাগানুগা ভক্তি বলা হয়। তাই তো শ্রীরাধা সব সময় সর্বত্র কৃষ্ণ সান্নিধ্যের জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। সেই ব্যাকুলতা থেকে ভাবের জগতে তাঁর কৃষ্ণ প্রাপ্তি ঘটে। তাতেই তিনি আনন্দিত। তাঁর সেই আনন্দকে তিনি প্রকাশ করেছেন তার সখীদের কাছে। ঈশ্বরের স্পর্শ সুখ অনুভবের জন্য রাধিকার এই আকুলতা যদি ভক্তের হৃদয়ে জাগ্রত হয়, তাহলে তিনিও সচ্চিদানন্দের নৈকট্য লাভ করতে পারবেন।

আলোচ্য পদটিতে মর্ত্যপ্রেমের যে লৌকিক চিত্র ধরা পড়েছে, তা আলোচনা করো।

মর্ত্যপ্রেমের লৌকিক চিত্র: মিলনে সুখ, আর বিরহে দুঃখ-এ ভাবনা পার্থিব। শ্রীরাধা অনুভব করেছেন যে, কৃষ্ণ তাঁর ঘরে চিরতরে এসেছেন। সুখের জোয়ার রয়েছে তাঁর হৃদয়ে। বাঙালি গৃহবধূ যেমন স্বামীগতপ্রাণা হয়, তেমনি রাধাও কৃষ্ণগতপ্রাণা। কারণ, তিনি ভাবেন, তাঁর আঁচলে যদি মহা মূল্যবান রত্নরাজি থাকত, তাহলে দূর দেশে কৃষ্ণকে পাঠাতে হত না। কৃষ্ণ রাধার কাছে শীতের ওড়না, বর্ষার ছাতা আর অকুল সমুদ্রের পারানি। আবার, তেমনি, গ্রীষ্মের তপ্ত বাতাসও শ্রীকৃষ্ণ। তা ছাড়া যে বিরহ থেকে শ্রীরাধার অন্তরে ভাব সম্মিলন ঘটেছে তাও তো পার্থিব প্রেমেরই সমতুল্য। এইভাবে বিদ্যাপতি যে তুলনা এনেছেন তা পার্থিব অনুষঙ্গকেই কেন্দ্র করে।

“চিরদিনে মাধব মন্দিরে মোর।।”-মাধব কে? বক্তার এরূপ অনুভূতির কারণ কী?

মাধবের পরিচয়: বৈষ্ণব তত্ত্বকথা অনুসারে মাধব হলেন শ্রীবিষ্ণুর অবতার শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীরাধার আরাধ্য প্রাণের দেবতা, তাঁর প্রেমাস্পদ।

বক্তার অনুভূতির কারণ: শ্রীকৃষ্ণের মথুরা গমনের পর একসময় বক্তা অর্থাৎ, রাধা এই ভাবনায় উত্তীর্ণ হয়েছেন যে, তিনি সশরীরে না হলেও রাধার অন্তরের আসনে সদা বিরাজমান। রাধা ভেবেছেন, শ্রীকৃষ্ণ ফিরে এসেছেন চিরদিনের জন্য। আসলে শরীরী কৃষ্ণকে যে-কেউ কেড়ে নিতে পারে। কিন্তু রাধার অন্তরে যাঁর অবস্থান সেই কৃষ্ণকে, সেই অনুভূতিকে কেড়ে নেওয়া সম্ভব নয়। তাই এই মিলন শাশ্বত।

“পাপ সুধাকর যত দুখ দেল।”-সুধাকর কে? তাকে ‘পাপ সুধাকর’ বলার কারণ কী? বক্তাকে কীভাবে সে দুঃখ দিয়েছে?

সুধাকরের পরিচয়: সুধাকর হল চাঁদ।

পাপ সুধাকর বলার কারণ: চাঁদের রূপে আমরা মুগ্ধ হই, কিন্তু চাঁদ থাকে দূরে। তাই অতৃপ্তির যন্ত্রণা হৃদয়কে কুরে কুরে খায়। তা ছাড়া প্রতি রাতে ফিরে ফিরে এসে সে কৃষ্ণের অনুপস্থিতির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে পিয়াবিহনের তীব্রতাকে বাড়িয়ে দেয়। তাই তাকে ‘পাপ’ বলা হয়েছে।

বক্তাকে দুঃখ দেওয়ার কারণ : বক্তা অর্থাৎ, রাধা দূরের আকাশের চাঁদের মতো মথুরাগামী কৃষ্ণের জন্য অপেক্ষা করেছেন অধীরভাবে। কিন্তু কৃষ্ণ ফেরেননি, তাদের মিলন হয়নি। এই অতৃপ্ত মিলন পিপাসাই তাঁকে দুঃখ দিয়েছে।

“পিয়া-মুখ-দরশনে তত সুখ ভেল।।”-কে ‘পিয়া-মুখ’ দর্শন করেছেন? তাতে তাঁর সুখের কারণ কী?

‘পিয়া-মুখ’ দর্শনকারী: শ্রীরাধা তাঁর প্রিয় অর্থাৎ, কৃষ্ণের মুখদর্শন করেছেন।

সুখের কারণ : দীর্ঘদিনের অতৃপ্তির যন্ত্রণা ক্ষণিকের তৃপ্তির কারণে প্রশমিত হয়। রাধা কৃষ্ণের জন্য অনেক দিন ধরে অপেক্ষা করেছেন। কিন্তু কৃষ্ণ আর ফিরে আসেননি, রাধাকে কোনো খবরও পাঠাননি। ফলে বিরহজ্বালা বেড়েছে উত্তরোত্তর। কিন্তু বিরহের চরম পর্যায়ে পৌঁছে রাধিকা ভাবে কৃষ্ণসনে মিলিত হয়েছেন। অন্তরের অন্তঃস্থলে কৃষ্ণকে লাভ করে তিনি পরিতৃপ্ত হয়েছেন এবং অবশেষে তাঁকে চিরতরে পেয়ে তাঁর মনের সমস্ত বেদনা দূর হয়ে গেছে।

“আঁচর ভরিয়া যদি মহানিধি পাই।”-‘আঁচর’ শব্দের অর্থ কী? মহানিধি পেলে কী হবে?

‘আঁচর’ শব্দের অর্থ : ‘অঞ্চল’ বা ‘আঁচল’ শব্দ থেকে ব্রজবুলিতে ‘আঁচর’ শব্দটি এসেছে।

মহানিধি পেলে মা হবে: রাধা কৃষ্ণের মথুরা গমনের বাস্তব সত্যটি বিষয়ে অবগত নন। তিনি জানেন না কৃষ্ণ কংস নিধনের জন্য মথুরা গেছেন। তিনি অবগত সমাজের বাস্তবতা সম্বন্ধে। তিনি ভেবেছেন যে, তিনি গৃহবধূ, উপায়ক্ষম নন। তাই প্রিয় কৃষ্ণকে দূর দেশে কর্মের উদ্দেশ্যে পাঠাতে হয়েছে তাঁকে। এমতাবস্থায় রাধা যদি মহামূল্যবান রত্ন পান, তাহলে কৃষ্ণকে কাছে রেখে দিতে পারবেন সব সময়ের জন্য। বিদ্যাপতি এর মধ্য দিয়ে বাঙালির গার্হস্থ্য জীবনের বিরহবেদনাদীর্ণ একটি সুন্দর ছবি ফুটিয়ে তুলেছেন।

“শীতের ওঢ়নী পিয়া গীরিষির বা।”-কার সম্পর্কে এ কথা বলা হয়েছে? কথাটির অর্থ বুঝিয়ে দাও।

উদ্দিষ্ট ব্যক্তি: শ্রীরাধা শ্রীকৃষ্ণের সম্বন্ধে প্রশ্নোদ্ভূত এই কথাগুলি বলেছেন।

মর্মার্থ : শ্রীরাধার সর্বৈব সত্তা অধিকার করে রয়েছেন শ্রীকৃষ্ণ। বিপদে তিনি ত্রাণকর্তা, আবার তিনিই তাঁর যন্ত্রণার কারণ। শীত নিবারণের জন্য ওড়না যেমন গায়ে লেপটে থাকে, কৃষ্ণ রাধার কাছে তেমন। আবার, গ্রীষ্মের তাপ যখন অসহ্য হয়ে ওঠে তখন বয়ে যাওয়া বাতাসের অনুভূতি শ্রীরাধাকে শ্রীকৃষ্ণের স্পর্শানুভূতির জন্য আকুল করে তোলে। আসলে, যে প্রেমে যন্ত্রণা নেই, তার সুখও নেই। এ কথাই বোঝানো হয়েছে আলোচ্য অংশে।

শ্রীরাধা কৃষ্ণকে কেন ‘বরিষার ছত্র’ এবং ‘দরিয়ার না’ বলেছেন?

‘বরিষার ছত্র’ বলার কারণ: বর্ষায় ছাতা শুধু প্রিয় জিনিস নয়, অত্যন্ত প্রয়োজনীয় জিনিস। রাধার কাছে কৃষ্ণপ্রেম শুধুমাত্র শৌখিন প্রেমের বিলাস নয়, তাঁর জীবন ও আত্মার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত অপরিহার্য সম্পদ। তাই এ কথা বলা হয়েছে।

‘দরিয়ার না’ বলার কারণ: ‘দরিয়া’ হচ্ছে সমুদ্র, ‘না’ হল নৌকা। সমুদ্র পাড়ি দিতে গেলে নৌকা আবশ্যক। রাধার কাছে শ্রীকৃষ্ণের প্রেম সমুদ্রতুল্য অসীম। তাঁর একমাত্র উপলক্ষ্য শ্রীকৃষ্ণ নৌকা সদৃশ। তিনিই এই অকুল দরিয়ার পারানি, দিকনির্ণায়ক। তাই এ কথা বলা হয়েছে।

“সুজনক দুখ দিবস দুই-চারি।।”-উক্তিটির উৎস লেখো। কবির এই উক্তিটির তাৎপর্য লেখো।

উৎস: মৈথিল কোকিল কবি বিদ্যাপতি তাঁর ‘ভাব সম্মিলন’ পদে শ্রীরাধা সম্পর্কে উদ্ধৃত মন্তব্যটি করেছেন।

তাৎপর্য: কবি বলতে চান যে, শ্রীরাধা হলেন এই মর্ত্য পৃথিবীর শুদ্ধতম প্রেমিকা। তাঁর মতো ভালো মানুষ বিরল। তাই ঈশ্বরও তাঁকে বেশিদিন দুঃখ দিতে চান না, বিরহ যন্ত্রণায় দগ্ধ করতে চান না। তাই, ভাবে ও ভাবনায় তাঁর শূন্য মন্দিরে কৃষ্ণের পদার্পণ ঘটেছে এবং বিরহ যন্ত্রণা থেকে তিনি মুক্ত হয়েছেন।

“শীতের ওঢ়নী পিয়া গীরিষির বা।”-কথাটির অর্থ বুঝিয়ে দাও।

অর্থঃ শ্রীরাধা তাঁর সখীদের কাছে কৃষ্ণের স্বরূপ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন যে, তাঁর কাছে শ্রীকৃষ্ণ শীতের ওড়নাতুল্য অর্থাৎ, গাত্রাবরণের মতোই আরামপ্রদ। আবার, গ্রীষ্মের প্রবল দাবদাহের মধ্যে বয়ে যাওয়া বাতাসে যেমন আমাদের দেহ ও মন জুড়িয়ে যায়, শ্রীকৃষ্ণের স্পর্শানুভূতিও তেমনি শ্রীরাধিকার দেহ ও মনকে আকুল করে তোলে।

“বরিষার ছত্র পিয়া দরিয়ার না।।”-কার সঙ্গে রাধা এরূপ তুলনা করেছেন? কেন?

তুলনা : কৃষ্ণের সঙ্গে রাধা প্রশ্নোক্ত অংশে বর্ণিত তুলনাটি করেছেন।

তুলনার কারণঃ কৃষ্ণ রাধাকে সবসময় নানা বিপদের হাত থেকে আগলে রাখেন, অন্ধকারে পথ দেখান। কখনো-বা বর্ষার ছাতার মতো, কখনো-বা সমুদ্রের নৌকার মাঝির মতো। তিনিই রাধার কাছে অকুলের কুল, অগতির গতি, পতিতের পতিতপাবন।

‘ভণয়ে বিদ্যাপতি’- ভণিতা কাকে বলে?

ভণিতা: প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় কবিদের মধ্যে কাব্যের অন্দরে আত্মপরিচয় লিখে রাখার একটা প্রবণতা ছিল। আসলে তৎকালীন সময় লিখিত কাব্য সংগ্রহের নিশ্চয়তা ছিল না। বহুক্ষেত্রেই মূল পুথির শুরুর ও শেষের পৃষ্ঠা যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে যেত। তাই তৎকালীন কবিরা পদান্তে একটি পঙ্ক্তিতে নিজেদের আত্মপরিচয় লিখে রাখতেন। পদান্তে আত্মপরিচয়জ্ঞাপক পক্তি ব্যবহারের এই রীতিকে ভণিতা বলে।

ভণিতার মাধ্যমে বিদ্যাপতি কী বলতে চান?

ভণিতায় প্রকাশিত বক্তব্য: ভণিতার মাধ্যমে বিদ্যাপতি বলতে চান যে, রাধা নারীশ্রেষ্ঠা; সুতরাং, তাঁর মতো ভালো মানুষের জীবনে দুঃখ দু-চার দিনের বেশি স্থায়ী হবে না। তবে ভণিতা রচনার কারণ শুধু এটুকুই হতে পারে না। শ্রীরাধার গুণকীর্তন করতে গিয়ে নিজের পরিচয়টুকুও কবি গেঁথে ফেলেছেন ভণিতা অংশে। এই পদটি যে বিদ্যাপতির নিজের রচনা, তাঁরই অনুভব রাধিকার অনুভূতি রূপে প্রকাশ লাভ করেছে, তা-ই তিনি ভণিতা করে বলেছেন।

“কি কহব রে সখি আনন্দ ওর।”-রাধার আনন্দের কারণ কী?

অথবা

“কি কহব রে সখি আনন্দ ওর।”-উদ্ধৃত কথাটি বলার কারণ কী?

কারণ: রাধাকৃষ্ণের প্রেম পর্যায়ের অন্যতম পর্যায় হল মাথুর অর্থাৎ, বিরহের পর্যায়। কিন্তু রাধার মনন সেই চিরবিরহের পর্যায় পার করে উত্তীর্ণ হয়েছে ভাব সম্মিলনে। যেখানে মনমাঝে তিনি দর্শন পেয়েছেন কৃষ্ণের। এমতাবস্থায় দীর্ঘ শূন্যতা যাপনের পর রাধার মনের ঘরে তাঁর প্রিয়তম কৃষ্ণ এসেছেন, এতেই রাধার আনন্দের কোনো সীমা নেই। সেই আনন্দই তিনি তাঁর সখীদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চেয়েছেন এবং নিজের মনের আনন্দের প্রাবল্য বিষয়ে তাঁদের অবগত করতে চেয়েছেন। তাই তিনি উদ্ধৃত কথাটি বলেছেন।

“চিরদিনে মাধব মন্দিরে মোর।।”- কথাটির অর্থ বুঝিয়ে দাও।

অর্থ : কবি বিদ্যাপতি সুখের কবি। তাই তিনি, বিরহের অশ্রু নয় মিলনের আনন্দাশ্রুতে ভরিয়ে তুলতে চেয়েছেন মর্ত্যের রাধিকাকে। মাথুরে রাধাকৃষ্ণের চিরবিচ্ছেদ ঘটে। কিন্তু বিদ্যাপতি সেই বিচ্ছেদকে চিরকালীন হতে দেননি, রাধার মনের মাঝে ফিরিয়ে দিয়েছেন তাঁর প্রিয়তমকে। তবে রাধার অন্তর্লোকে যখন কৃষ্ণ নিবাস শুরু করেন সে অবস্থান চিরকালীন। সেখান থেকে তিনি আর কোনোদিন চলে যাবেন না। সে-কথা বলতে গিয়েই শ্রীরাধা বলেছেন যে, কৃষ্ণ তাঁর কাছে চিরদিনের জন্য এসে ধরা দিয়েছেন। এবার তাঁর বিরহের পুরোপুরি অবসান ঘটল।

“পাপ সুধাকর যত দুখ দেল।”-সুধাকরকে ‘পাপ’ বলা হয়েছে কেন?

‘পাপ’ বলার কারণঃ সুধাকর অর্থাৎ, চাঁদ তার সৌন্দর্য দিয়ে দূর থেকে হাতছানি দেয়, কিন্তু ধরা দেয় না। চাঁদের আকর্ষণে উন্মুখ হয়ে থাকে জ্যোৎস্নাপিয়াসি মানুষ, কিন্তু তার পরিতৃপ্তি নেই। চাঁদের এই ছলনার জন্যই চাঁদকে ‘পাপ’ বলা হয়েছে। আসলে কৃষ্ণের মথুরায় গমনের পর রাধা মণিহারা ফণির মতো দিনযাপন করেছেন। রাত্রে চাঁদের আগমন ঘটেছে নির্ধারিত সময়েই কিন্তু অভিসারে যেতে হয়নি রাধারানিকে। এমতাবস্থায় কৃষ্ণহীন নিশাযাপন তাঁকে পীড়িত করেছে, আকাশের সুধাকরের উজ্জ্বল অবস্থান তাঁর বিরহতাপিত অবস্থার কথা বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। তাই সুধাকর সম্বন্ধে রাধারানির এহেন অভিমত।

“পিয়া-মুখ-দরশনে তত সুখ ভেল।।”-উদ্ধৃত পত্তির মধ্য দিয়ে রাধা কী বলতে চেয়েছেন?

তাৎপর্য: বিদ্যাপতি রচিত ‘ভাব সম্মিলন’ পদটি রাধারানির কৃষ্ণ ভাবাক্রান্ত রূপের বর্ণনায় পূর্ণ। কৃষ্ণ সন্দর্শনে রাধিকার মনোভাবই ব্যক্ত হয়েছে প্রশ্নোক্ত উদ্ধৃতিটিতে। শ্রীরাধা তাঁর সখীদের বলেছেন যে, চাঁদ দেখেও যে সুখ পাওয়া যায় না, প্রিয়তম শ্রীকৃষ্ণের মুখ দেখে সেই সুখ তিনি পেয়েছেন। রাধিকার কাছে কৃষ্ণদর্শনের মহনীয়তা প্রকাশ করার জন্যই রাধারানি এহেন তুলনাত্মক উক্তি করেছেন।

“আঁচর ভরিয়া যদি মহানিধি পাই।”- ‘মহানিধি’ শব্দের অর্থ কী? মহানিধি পেলে কী হবে?

‘মহানিধি’ শব্দের অর্থঃ ‘মহানিধি’ শব্দের অর্থ হল ‘মহামূল্যবান রত্ন’।

মহানিধি পেলে যা হবে: কর্মের তাগিদে স্বামীদের দূরদেশে পাড়ি জমাতে হত এবং স্ত্রীদের তখন বিরহতাপিত কাল কাটাতে হত। সেই একই পর্যায়ে শ্রীরাধা নিজেকে ফেলেছেন। শ্রীকৃষ্ণ তাঁর স্বামীতুল্য। কর্মসূত্রে তিনি মথুরায় চলে গেছেন। তাই মহানিধি পেলে শ্রীরাধা কৃষ্ণকে দূর দেশে যেতে দেবেন না। কেন-না, তখন অর্থের অভাব দূর হবে।

কৃষ্ণ কেন দূর দেশে গেছেন?

কৃষ্ণের দূর দেশে যাওয়ার কারণঃ বিদ্যাপতি রচিত ‘ভাব সম্মিলন’ পদটিতে শ্রীকৃষ্ণের যে দূরদেশে গমনের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন তার পরিচয় পাওয়া যায় শ্রীকৃষ্ণ কথামূলক সকল পুরাণে। পুরাণ অনুসারে জানা যায় যে, অত্যাচারী কংস রাজা যিনি কৃষ্ণের মামা, তাঁকে বধ করার জন্য কৃষ্ণ মথুরায় গমন করেছিলেন এবং কর্মান্তে তিনি আর বৃন্দাবনে কখনও ফিরে আসেননি।

আরও পড়ুন – ছাত্রজীবন – মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top