“বাংলা সাহিত্যে ‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার’ গল্পটি এক অভিনব সৃষ্টি।”- উক্তিটির যথার্থতা বিচার করো

যথার্থতা বিচার : বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক প্রেমেন্দ্র মিত্রের লেখা ‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার’ গল্পটি অঙ্গবিন্যাস এবং ভাবকল্পনায় এক অসাধারণ সৃষ্টি। বিশ্ব সাহিত্যে গণনাতীত সার্থক ছোটোগল্প রচিত হয়েছে, সেই সার্থকতার মধ্যেও ‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার’ গল্পটি আপন অভিনবত্বে ব্যতিক্রমী।
অঙ্গবিন্যাসঃ উদ্দেশ্যমুখীন এই গল্পটি যাতে পাঠকের হৃদয়কে পরিপূর্ণ রূপে স্পর্শ করে, তার জন্য গল্পের গঠনরীতিতে চমক সৃষ্টি করলেন গল্পকার-
প্রথমত: এই গল্পের কাহিনিকে পাঠক নিজেই যেন অবশ্যম্ভাবী রূপে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। কাহিনি শুরু হয়েছে এইভাবে “শনি ও মঙ্গলের, মঙ্গলই হবে বোধ হয়, যোগাযোগ হলে তেলেনাপোতা আপনারাও একদিন আবিষ্কার করতে পারেন।” অর্থাৎ, প্রথম থেকেই পাঠকের হাতে ছেড়ে দিলেন কাহিনিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব। এখানে পাঠক স্বয়ং গল্পকথক, তেমনি গল্পের প্রতিটি চরিত্র রূপে পাঠকেরই উপস্থিতি।
দ্বিতীয়তঃ কোনো-এক অপরিচিত জগতে ভ্রমণে গিয়ে গল্পের চরিত্রগুলির অতীত অভিজ্ঞতা এখানে বর্ণনা করেননি গল্পকার। এই মানসভ্রমণে পাঠক কী অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে, তার এক সম্ভাবনার ছবি এঁকেছেন ভবিষ্যৎ কালকে ক্রিয়াপদ রূপে ব্যবহার করে। কোথাও কোথাও সাধারণ ভবিষ্যৎ থেকে তিনি পুরাঘটিত ভবিষ্যতের আশ্রয় নিয়েছেন, “হঠাৎ হয়তো বলে ফেলবেন, চলো ‘আমিও যাবো।” পুরাঘটিত ভবিষ্যতের মেজাজে লুকিয়ে থাকে সম্ভাব্য অতীত। অর্থাৎ, এই গল্পের যে ‘প্লট’, তার নির্দিষ্ট কোনো কালসীমা নেই। এ ধরনের ঘটনা অতীতে ঘটে থাকতে পারে, আবার বর্তমানের পথ বেয়ে ভবিষ্যতেও ঘটার সম্ভাবনা আছে।
ভাবকল্পনা : পটভূমি রূপে গ্রহণ করা এক অন্ধকারাচ্ছন্ন বিস্মৃতপ্রায় মায়াময় পরিবেশের সঙ্গে এই গল্পের ক্লাইম্যাক্সকে অদ্ভুত দক্ষতায় লেখক মিশিয়ে দিয়েছেন। এই গল্পের ট্র্যাজিক চরিত্র যামিনী। পানাপচা সরোবরের মতোই দারিদ্র্যক্লিষ্ট, সঙ্গীহীন, একঘেয়ে জীবন হঠাৎ কখনও বড়শি বিদ্ধ হওয়ার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মুহূর্তে হারিয়ে যায়। ঘন অন্ধকারে সূর্যের অস্থায়ী আলোর ছটার মতো দু-একটি পুরুষ চরিত্র আবির্ভূত হয়ে তার হৃদয়কে নিংড়ে নিয়ে চলে যায়।
এভাবেই নানা রঙের আলপনায় ‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার’ বাংলা সাহিত্যের এক অভিনব ছোটোগল্প হয়ে উঠেছে।