বই মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধু – মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা

বই মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধু – মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা

বই মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধু - মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা
বই মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধু – মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা
  • প্রাচীন ও গ্রন্থ পাঠ
  • আনন্দ ও মানসিক সুস্থতা
  • পাঠাগারের সাহিত্য ভান্ডার
  • বই পড়া ও সঙ্গ
  • বই পড়া ও শখ
  • বই পড়ার উপযোগিতা
  • উপলব্ধি ও বোধের অপরিহার্য

জ্ঞানের রহস্যময় ভাণ্ডার হল বই। বই পড়েই মানুষ আজানাকে জানতে পারে, অচেনাকে চিনতে পারে। বই অন্ধকার দূর করে সভ্যতার অগ্রগতি ঘটায়। তাই বই যেমন সভ্যতার রক্ষাকবজ তেমনি সভ্যতার চাবিকাঠি। সভ্যতার আদি লগ্ন থেকেই বই অতীত ও বর্তমানের বহুমুখী জ্ঞান সম্পদকে বহন করে চলেছে। বিদ্যার্থীদের প্রতি দেবী সরস্বতীর দুটি প্রধান দান- বীণা ও পুস্তক। বীণা অর্থাৎ সুর ও গান যা মানুষের অন্তর এবং বাহিরের সঙ্গী, আর বই তার চিন্তা আবেগ উপলব্ধি ও বোধের অপরিহার্য দিকদর্শন।

মানুষ বই পড়তে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে সেই প্রাচীন কাল থেকে। প্রাচীন যুগে বই পড়াটা নাগরিকদের মধ্যে একটা বড়ো রকমের মর্যাদার ব্যাপার ছিল। প্রাচ্যের নাগরিক সমাজ কাব্যকে মনের বেশভূষা উপকরণ হিসেবে দেখত। ইউরোপের সভ্য সমাজে বই পড়া একটি সাংস্কৃতিক ব্যাপার বলে বিবেচিত। বই পড়া সর্বকালের সব দেশের মানুষের শখ। বিভিন্ন রুচির মানুষ তাদের রুচি অনুযায়ী বইয়ের পাতায় চোখ রেখে শখ চরিতার্থ করে। বই বা সাহিত্যসমাজ মানবমনের দর্পণ বিশেষ। মানুষের মনের প্রতিচ্ছবি হল সাহিত্য। মানুষ ও সমাজকে সম্পূর্ণ রূপে জানবার জন্যই বই পড়া দরকার।

বই পড়া ছাড়া সাহিত্য পাঠ ও সাহিত্যচর্চার অন্য কোনো উপায়ন্তর নেই। এই চর্চার জন্য একক গ্রন্থ সম্ভব নয়, চাই গ্রন্থাগার। ধর্ম, দর্শন, নীতি ও বিজ্ঞানচর্চা যথাক্রমে মন্দির, গুহা, ঘর এবং গবেষণাগারে করা গেলেও বিদ্যা সংগ্রহ ও চর্চার জন্য পাঠাগারই একমাত্র স্থান। মনের সুস্থতার উপর অনেকাংশে দেহের সুস্থতা নির্ভর করে। মনকে সুস্থ রাখতে হলে ভালো বই পড়া দরকার। ভালো বই পড়াশুনার মধ্য দিয়ে মানুষের মনে আত্মমর্যাদাবোধ সম্পর্কে চেতনা জাগে। ভালো বই পাঠককে সচেতন মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে। ভালো বই মানে ভালো বন্ধু ও যোগ্য শিক্ষক। তা ছাড়া আমরা দেখি যেসব মানুষেরা বইকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেছে তাদের শত্রু অনেক কম। কারণ বই জ্ঞানের প্রতীক, বই আনন্দের প্রতীক। বইয়ের মাধ্যমে বিশ্বমানবের সঙ্গে যোগ ঘটে।

আমাদের পৃথিবীতে মানুষের বহু শখ আছে এবং শখ মেটাবার উপযুক্ত ক্ষেত্রও আছে। আজকাল সবারই কিছু না-কিছু শখ রয়েছে- খেলাধুলা, রান্নাবান্না, গল্পগুজব, বইলেখা ও তা কাউকে পড়ে শোনানো, গানবাজনা করা, বাগানে ফুলচাষ করা ইত্যাদি। তবে এ কথাও ঠিক যে আমাদের মতো রোগশোক, দুঃখদারিদ্র্যের দেশে জীবনধারণ করাই যখন প্রধান সমস্যা তখন মানুষের শখের আলোচনা করা তথা বই পড়াকে শখ হিসেবে গ্রহণ করার মানসিকতা কত জনের থাকবে তাতে সন্দেহ আছে।

নিঃসঙ্গ জীবন মানুষের কাছে অভিশাপ স্বরূপ। সেই নিঃসঙ্গতা আজকের আধুনিক মানুষের নিত্যসঙ্গী। সেই প্রাচীন একান্নবর্তী পরিবারও নেই, নেই সামাজিক শৃঙ্খল। মানুষ স্বার্থপরতার নিগড়ে নিজেকে বেঁধে ফেলে বৃহৎ জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন। আর বিচ্ছিন্ন বলেই তাকে নিঃসঙ্গতার যন্ত্রণা কুরে কুরে খায়। সেই নিঃসঙ্গ মানুষের কাছে বই হতে পারে অন্যতম সঙ্গী। বিশেষ করে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের কাছে বই পড়ার বিকল্প নেই বললেই চলে। বই মানুষকে চেতনাসম্পন্ন নাগরিকে পরিণত করে।

বই আসলে মানুষের চৈতন্য ও মনিষার সৃষ্টিকর্তা। লেখকের উপলব্ধিজাত অভিজ্ঞতা বইতে লিপিবদ্ধ হয়। যা উপলব্ধি করলে মানুষ সচেতন নাগরিক হয়ে ওঠে। জীবনকে বুঝতে হলে, অভ্যেসের সংস্কারের বেড়া ভাঙতে হলে, বইয়ের সঙ্গ অবশ্যই প্রয়োজন। প্রমথ চৌধুরী বলেছেন, “বৈঠকখানার দেওয়ালে হাজার টাকার একখানি নোট না ঝুলিয়ে। হাজার টাকা দামের একখানা ছবি ঝোলানোতে যে আর্থিক সুরুচির পরিচয় দেয়, তেমনি নানা আকারের নানা বর্ণের রাশি রাশি বই সাজিয়ে রাখাতে প্রমাণ হয় যে, গৃহকর্তা একাধারে ধনী এবং গুণী”।

বই হল আয়নার মতো, যাতে আমাদের নিজেদের মনের প্রতিবিম্ব ধরা পরে। বইবিহীন জীবনকে আত্মাবিহীন দেহের সঙ্গে তুলনা করা চলে। বাংলায় একটি প্রবাদ আছে যে ‘ধনবানে কেনে বই গুণবানে পড়ে’। এই প্রবাদটি আংশিক সত্য। যে প্রকৃত গুণবান, সে অনেক সময় নিজেকে নিঃস্ব করে বই কেনে। বই কেনা যেমন নেশা, তেমনি বই পড়াও এক আনন্দময় নেশা। কিন্তু একটা বাস্তবিক কথা হল আমরা নিজেদেরকে সত্য নাগরিক বলে প্রতিপন্ন করতে চাই। বইও সৌখিন আলমারিতে সাজিয়ে রাখি।

কিন্তু সেই সেভাবে পড়ে নিজেদেরকে সংস্কৃতিমনস্ক হিসেবে গড়ে তোলায় আমরা নিরানন্দ অনুভব করি। তার অন্যতম কারণ আমরা শ্রমবিমুখ। সেইজন্য পরিশ্রম করে বই পড়ি না বা অভ্যাস গড়ে তুলি না। তাই বাহ্যিক দিক থেকে আমরা সভ্য হলেও অন্তরে আমরা দেউলিয়া হয়ে পড়েছি। সেই দেউলিয়া মনভাব সরিয়ে বই পড়াকে সঙ্গ ও শিক্ষা উভয় দিক থেকে গ্রহণ করলে ব্যক্তি ও জাতির উন্নতি অনেকটাই সম্ভব হতে পারে।

আরও পড়ুন – ছাত্রজীবন – মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top