ছুটি গল্প অবলম্বনে ফটিকের চরিত্রটি বিশ্লেষণ করো

ফটিক চরিত্র
যুগপুরুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সাধনা’ পর্বে একটি উল্লেখযোগ্য গল্প ‘ছুটি’। রবীন্দ্র গবেষকরা নির্দেশ করেছেন এই গল্পের প্রধান চরিত্র ফটিককে রবীন্দ্রনাথ বাস্তব জীবন থেকেই আহরণ করেছেন। উদার মুক্ত পল্লিজীবন থেকে শহরে চার দেয়ালের বন্দিত্বে চলে আসা ফটিক জীবন থেকে ছুটি চায়। অবশেষে চিরশান্তির ছুটি সে পায়। এভাবেই সমগ্র গল্পে সে ধরা দিয়েছে।
ফটিকের স্বভাব-বৈশিষ্ট্যঃ বিধবা জননীর দুরন্ত পুত্র ফটিকের বয়স তেরো কী চোদ্দো। দুরন্ত দামাল ফটিক তার বন্ধুবর্গের সর্দার। মাথায় তার নিত্যনতুন ভাবনার উদয় হয়। তারই নির্দেশে অন্যান্য বালকেরাও দুষ্টুমিতে মাতে। ফটিক পড়াশোনায় নিতান্তই অমনোযোগী এবং বেশ উৎশৃঙ্খল। গ্রামবাংলার মুক্ত প্রকৃতি, অনন্ত নীল আকাশ, সেই আকাশে ভেসে বেড়ানো রংবেরঙের ঘুড়ি, আঁকাবাঁকা নদীতীর ফটিকের চারণভূমি।
শহরে চার দেয়ালে আবদ্ধ ফটিক: ফটিকের দুষ্টুমি কমানোর জন্য, তাকে জীবনের পথে মাথা উঁচু করে বাঁচার জন্য লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মতো মানুষ করতে মাতৃক্রোড় থেকে তাকে নিয়ে আসা হল শহরে মামাবাড়িতে। শহরে এসে বিন্দুমাত্র স্বস্তি পেল না ফটিক। স্নেহহীনা মামির অত্যাচার-গঞ্জনা-তিরস্কার তাকে শহরবিমুখ করে তোলে। স্কুলে পড়া না পারলে শিক্ষকের মারধোর সহ্য করতে হয়। বই হারিয়ে মামির সামনে লজ্জিত হয়-“সে যে পরের পয়সা নষ্ট করিতেছে, এই মনে করিয়া তাহার মায়ের উপর অত্যন্ত অভিমান উপস্থিত হইল;”
জীবনবিমুখতা তথা জীবন থেকে ছুটি: বই হারানোর দিনে স্কুল থেকে ফিরে জ্বর আসে ফটিকের। জ্বরগ্রস্ত শিরে স্পর্শ চায় মাতৃসমা কারওর। কিন্তু শহরে মামাবাড়িতে এই প্রত্যাশায় লজ্জা অনুভব করে সে। শরীরে তীব্র জ্বর নিয়ে মায়ের কাছে ফিরতে চায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিশ্বম্ভরবাবু অনেক খুঁজে তাকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনেন। স্নেহবঞ্চিত, ভালোবাসাহীন, বদ্ধ জীবন থেকে মুক্তিকামী ফটিক মামাকে জিজ্ঞেস করে কবে তার ছুটি হবে।
রোগশয্যায় প্রবল জ্বরতপ্ত ঠোঁটের অবুঝ প্রলাপে অবশেষে মায়ের দর্শনে ফটিক বলে ওঠে “এখন আমার ছুটি হয়েছে মা, এখন আমি বাড়ি যাচ্ছি।” নগর থেকে নির্বাসিত ফটিক মায়ের প্রতি ভালোবাসার অবুঝ টান অনুভব করেছে মৃত্যুতে। সে যে প্রকৃতির সন্তান, তার অনুভবও যেন মৃত্যুতে। জ্বরের প্রলাপে ফটিকের একটানা সুর করে বলতে থাকা “এক বাঁও মেলে না। দো বাঁও মেলে-এ-এ না।” প্রমাণ করে ফটিক অকূল সমুদ্রের পথেই যাত্রা করছে। হয়তো-বা, সামান্য স্নেহ পেলেই সে নোঙর ফেলত সংসারের নদীতটে।