প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার’ গল্পটি আসলে আত্ম-আবিষ্কারের গল্প-বিষয়বস্তুর নিরিখে মন্তব্যটি ব্যাখ্যা করো

মন্তব্যটির ব্যাখ্যা: প্রেমেন্দ্র মিত্র রচিত ‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার’ গল্পটি বিষয় নির্বাচনে এবং বর্ণনা ভঙ্গির অভিনবত্বে নিঃসন্দেহে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছোটোগল্প। নগর সভ্যতার কাছাকাছি এক বিস্মৃতপ্রায় কাল্পনিক জনপদ আবিষ্কারের মায়াচ্ছন্ন পরিবেশ রচনা করে গল্পকার পাঠককেই নিজের মনের আয়নার সামনে বসিয়ে দিয়েছেন। এ গল্পে নায়ক চরিত্রটি নামহীন। গল্পটি মধ্যম পুরুষে রচিত হওয়ায় পাঠক স্বয়ং এ গল্পে নায়কের আসনে অধিষ্ঠিত। গল্প জুড়ে নায়কের উপস্থিতি ও বিচিত্র ভাবান্তর মধ্যবিত্ত কল্পনাবিলাসী মানুষের অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়তা, করুণা ও সহমর্মিতা এবং সবশেষে দ্বিধাগ্রস্ত, পলায়নী মনোবৃত্তির নিখুঁত প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে।
তিনদিনের ছুটিতে শুধুমাত্র মাছ ধরার বাসনায় কলকাতা থেকে ত্রিশ মাইল দূরের এক জনবিরল গ্রামে যাওয়ার অভিজ্ঞতায় পাঠক শিহরিত, অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় সে নিজেই যেন পৌঁছে যায় সেখানে। তারপর মৃত্যুপথযাত্রী বৃদ্ধাকে নিয়ে তার একমাত্র কন্যা যামিনীর বেঁচে থাকার লড়াইয়ের প্রত্যক্ষদর্শী হয়ে পাঠকের হৃদয় বেদনার্দ্র হয়ে ওঠে। পরিবেশ ও পরিস্থিতির মিশ্র প্রভাবে আবেগাপ্লুত নায়কের মতোই পাঠকও যামিনীর জন্য মানবিক কিছু করার প্রেরণা পায়।
কিন্তু এরপরেই কল্পনাবিলাসিতার সঙ্গে বাস্তব রূঢ়তার দুস্তর ব্যবধান প্রকট হয়ে ওঠে। নিজের ভদ্রাসনে ফিরে এসে কথকের সেই ক্ষণিক আবেগ বা স্বপ্ন মোহময়তা মুছে যায় অচিরেই। মহানগরে ফিরে আসার পর কিছুদিন ম্যালেরিয়া জ্বরে আক্রান্ত থেকে সুস্থ হয়ে উঠলে তেলেনাপোতার স্মৃতি তার কাছে একটা ঝাপসা স্বপ্ন বলে মনে হয়। এই অস্পষ্টতা মধ্যবিত্ত মানুষের জীবনের দ্বিধাগ্রস্ত মোহাচ্ছন্নতা ও পলায়নী মনোবৃত্তিরই প্রকাশ। তার এই খণ্ডিত জীবনবোধ দেশকাল নিরপেক্ষ-এমনটাই ঘটেছিল কখনও কোথাও কোনো-এক অতীতে, এমনটাই ঘটবে অন্য কোনো ভবিষ্যতে। আর এভাবেই সমগ্র গল্পটি আত্ম-আবিষ্কারের অনবদ্য এক লেখচিত্র হয়ে ওঠে।