প্রাক্-নবজাগরণ পর্বে বিজ্ঞানচর্চার উপর আলোকপাত করো

প্রাক্-নবজাগরণ পর্বে বিজ্ঞানচর্চার উপর আলোকপাত করো

প্রাক্-নবজাগরণ পর্বে বিজ্ঞানচর্চার উপর আলোকপাত করো
প্রাক্-নবজাগরণ পর্বে বিজ্ঞানচর্চার উপর আলোকপাত করো

আধুনিক বিজ্ঞান বলতে মূলত পাশ্চাত্য বিজ্ঞানচর্চার কথা মনে করা হয়। ইউরোপীয় বিজ্ঞানের মূল প্রেরণা ছিল গ্রিক বিজ্ঞান। গ্রিক বিজ্ঞানের কথা আরবদের মারফৎ ইউরোপে প্রচারিত হয়। কিন্তু মনে রাখা দরকার যে, গ্রিকদের বিজ্ঞানসাধনার বহু আগে প্রাচ্যের নানা দেশ বিশেষত ভারত, চিন, মধ্যপ্রাচ্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চায় যথেষ্ট অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছিল।

প্রাক্ নবজাগরণ পর্বে বিজ্ঞানচর্চা

(1) প্রাক্-নবজাগরণ বিজ্ঞানচর্চার বৈশিষ্ট্য:

  • ধর্মের গুরুত্ব: প্রাক্-নবজাগরণ পর্বের বিজ্ঞানচর্চা ধর্মের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। এসময় পৃথিবী বিশ্বব্রান্ডের কেন্দ্রে অবস্থিত বলে ধারণা করা হত।
  • পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ: মধ্যযুগের বিজ্ঞানীগণ মূলত গভীর পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে জ্ঞান অর্জনে সচেষ্ট ছিলেন। তবে প্রকৃত পরীক্ষার মাধ্যমে তত্ত্ব যাচাইয়ের প্রক্রিয়া তেমন ছিল না। তার উপর প্রাক্-আধুনিক পর্বের পরীক্ষানিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের বিষয়টি আধুনিক যুগের গবেষণা পদ্ধতির তুলনায় ছিল সীমিত।

(2) প্রাচ্যের বিজ্ঞানচর্চা:

  • ভারত: ভারতবর্ষে বৈদিক যুগ থেকে পঞ্চদশ শতক পর্যন্ত জ্ঞান-বিজ্ঞানের ধারাবাহিক চর্চা লক্ষণীয়। পঞ্চম থেকে সপ্তম শতকে আর্যভট্ট-বরাহমিহির-ব্রহ্মগুপ্তের নেতৃত্বে ভারতবর্ষ বিজ্ঞানচর্চায় অনন্য কৃতিত্ব দেখাতে সক্ষম হয়। এঁরা গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যায় বিশেষ কৃতিত্ব অর্জন করেন। তাছাড়া চিকিৎসাবিদ্যা ও রসায়নে কৃতিত্ব দেখান নাগার্জুন, বাগভট্ট, চক্রপাণি দত্ত প্রমুখ।
  • চিন: মহাচিনে গাণিতিক ও জ্যোতিষশাস্ত্রে কৃতিত্ব দেখান লো-চি, হো-চেন-তিয়েন, সু চুংচি, চেন-লুয়ান প্রমুখ পণ্ডিত। এ ছাড়া ফা সিয়েন, সুয়ান জাং, ইৎ-সিং প্রমুখ বিশিষ্ট চিনা পর্যটক ও ভৌগোলিকগণ বিভিন্ন প্রাচ্য দেশসমূহের নানান জাতি এবং তাদের শিক্ষা-সংস্কৃতি, ভাষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞান বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করে চমকপ্রদ ভ্রমণবৃত্তান্ত তথা ভৌগোলিক গ্রন্থাদি রচনা করেন। চিনা কারিগর ও বিজ্ঞানীদের প্রয়াসে মুদ্রণ প্রণালী, কাগজ, কম্পাস, বারুদ ইত্যাদির ব্যাবহারিক প্রয়োগ উদ্ভাবিত হয়।
  • মধ্যপ্রাচ্য: মধ্যপ্রাচ্যে হলাগু খাঁর সাহায্যে নাসির অল-দিন অল-তুসি অত্যাধুনিক জ্যোতির্বিদ্যার মানমন্দির মারাঘা (Maraghah)-তে প্রতিষ্ঠা করে নির্ভুল জ্যোতিষচর্চার পথ খুলে দেন। তাছাড়া আরব ও ব্যাবিলন অপরসায়ন (কিমিয়াবিদ্যা বা কেমিয়াবিদ্যা / Alchemy) বিদ্যাচর্চার কাজে বিশেষ সাফল্য প্রদর্শন করে।

(3) পাশ্চাত্যের বিজ্ঞানচর্চা: নবজাগরণ পূর্ববর্তীকালে আরব পণ্ডিতদের রচনা অনুবাদের মাধ্যমে ইউরোপ জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিল। আরব অধিকৃত স্পেনে এসময় গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, রসায়নশাস্ত্র ইত্যাদির চর্চা চলত। একাদশ-দ্বাদশ শতক নাগাদ স্পেনের সঙ্গে যোগাযোগের সূত্রে পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানচর্চা বিষয়ে ইউরোপ বেশ আগ্রহী হয়ে উঠতে থাকে। আসলে খ্রিস্টীয় নবম থেকে দ্বাদশ শতক নাগাদ পশ্চিম ইউরোপের সঙ্গে আরবদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ গড়ে উঠলে পণ্ডিতদের মধ্যে পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানের প্রতি আকর্ষণ বাড়তে থাকে।

মূল্যায়ন

প্রাক্-নবজাগরণ পর্বের বিজ্ঞানচর্চার সূত্র ধরেই নবজাগরণ পর্বের বিজ্ঞানচর্চার উন্নতি ঘটতে থাকে। ইউরোপের নবজাগরণ পাশ্চাত্যের সমাজব্যবস্থায় যে পরিবর্তন আনে, তা বিজ্ঞানের দ্রুত উন্নতির অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি করে দেয়। চিন বা ভারতবর্ষ সেই পুরোনো ব্যবস্থার মধ্যে আবদ্ধ থাকে এবং ধীরে ধীরে পিছিয়ে পড়ে। অন্যদিকে ইউরোপ নবজাগরণ-সঞ্জাত উদারতা, মানবতাবাদ, যুক্তিবাদকে আশ্রয় করে এক নতুন মুক্ত পরিবেশে আধুনিক বিজ্ঞানচর্চার কাজে এগিয়ে যেতে থাকে।

আরও পড়ুন – ছাত্রজীবন – মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top