নুন কবিতার বিষয়বস্তু

নুন কবিতার বিষয়বস্তু

নুন কবিতার বিষয়বস্তু
নুন কবিতার বিষয়বস্তু

নুন কবিতার বিষয়বস্তু

দেশভাগ, উদ্বাস্তু সমস্যা, অন্নের হাহাকার, আর তারই মাঝে চলতে থাকে নিম্নবিত্ত মানুষের বেঁচে থাকার চেষ্টা ও স্বপ্ন দেখা। তবে শুধু তাই নয়, একঘেয়ে স্বপ্ন দেখা আর মুক্তিযন্ত্রণায় কাতর মানুষ ক্রমে নিজের অধিকার বুঝে নিতেও চেষ্টা করে। মানুষের এ এক ধরনের স্বাভাবিক প্রবণতা। রাষ্ট্রের কাছে, সমাজের কাছে সে জীবনযন্ত্রণা বিষয়ে নিজস্ব প্রশ্ন ছুড়ে দেয়। ‘নুন’ শব্দটির একটি অদ্ভুত বিশেষত্ব হল, তা একইসঙ্গে সামান্য কিংবা অসামান্যকে নির্দেশ করে। পাঠ্য কবিতায় কবি প্রান্তিক মানুষের দিন অতিবাহিত করার কাহিনি তুলে ধরতে গিয়ে নুনের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন। এ মানুষগুলো অল্পেই খুশি। অভাব-অনটন এদের কাছে সহ্যাতীত নয়। তাই সাধারণ মোটা ভাতকাপড়েই এদের দিন চলে। একঘেয়ে দুঃখকষ্টের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়াই এদের ভবিতব্য। সেইসঙ্গে রয়েছে রোগব্যাধি। দু-বেলার সামান্য রোজগারে থাবা বসাতে থাকে অসুখবিসুখ ও ধারদেনা। আর এইসব অর্থাভাব, অনাহার ভুলে থাকতে গঞ্জিকার শরণাপন্ন হতে হয়। ক্লান্ত, অবসন্ন মন ক্ষণিকের জন্য খুঁজে পায় সান্ত্বনা। এইসব দুঃখী ও অনাহারক্লিষ্ট মানুষগুলোর সবদিন বাজার করার সামর্থ্য থাকে না। তবে যেদিন হাতে অর্থ আসে, ক্ষুধার্ত মানুষের দীর্ঘলালিত স্বপ্নপূরণের ঘোরে এরা মাত্রাছাড়া বাজার করে। জরাজীর্ণ জীবনে নতুনের স্বপ্নে সৌন্দর্যের মোহে হয়তো বাড়ি ফেরার পথে গোলাপচারা কিনে আনে। কিন্তু পরমুহূর্তেই কঠোর বাস্তব, মনকে জিজ্ঞাসু করে তোলে। সৌন্দর্যের প্রতীক সেই গোলাপ গাছের স্থান সংকুলান কোথায় হবে। ক্রোনোক্রমে যদি-বা পোঁতা হয়, সেখানে ফুল ফুটবেই এমন নিশ্চয়তাও নেই। তাদের অস্তিত্বের মতোই যেন, এসবই সংশয়াচ্ছন্ন। তাই স্বপ্নের আচ্ছন্নতা কাটার উপক্রম হলেই হাতে তুলে নিতে হয় গঞ্জিকা। এভাবেই কোনোক্রমে অল্পে হেসে খেলে; কষ্ট করে কোনোক্রমে কাটিয়ে দেয়। দিন আনা, দিন খাওয়া এই মানুষগুলোর মাঝে মাঝে এমন অবস্থা হয় যে, দু-বেলা দু-মুঠোর সংস্থানটুকুও হয় না। খেটেখুটে রাতদুপুরে বাড়ি ফিরে যখন তারা দেখে ঠান্ডা ভাতে সামান্য লবণটুকুও নেই, অর্থাৎ খাওয়ার ন্যূনতম বন্দোবস্তটুকুই নেই; তখন মাথায় রাগ চড়ে যায়। অভাবের সংসারে লেগে যায় সাংসারিক ও পারিবারিক কোন্দল। বাপব্যাটা সমস্ত রকম সামাজিক সম্ভ্রমের মাথা খেয়ে যেন দুই ভাইয়ের খেয়োখেয়ির পর্যায়ে নেমে আসে। যদিও এ বিষয়ে সব পক্ষই নির্বিকার উদাসীন, ফলে কারও কোনো চক্ষুলজ্জা, অনুতাপ কিংবা মনোকষ্ট থাকে না। সমাজ, রাষ্ট্র কিংবা পরিপার্শ্বের কাছে এরা নিজেদের শুকনো ভাতে সামান্য লবণের প্রত্যাশাটুকু জানায়। সামান্য লোকেদের এই ততোধিক অসামান্য দাবির মধ্যে জীবনে অন্তত একবারের জন্যেও ফুটে ওঠে মানবিক দৃঢ়তা, সংঘবদ্ধতা ও সংকল্প।

কবিতার প্রেক্ষাপট

বিশ শতকের সাতের দশকের অন্যতম বিখ্যাত কবি জয় গোস্বামী। বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে তাঁর আবির্ভাব যেন ‘জাদু পিদিম’ হাতে নিয়ে। সাতের দশকের রাজনৈতিক অস্থিরতা সর্বজনবিদিত। এসময় দুই বাংলাতেই চলছিল পালাবদল। এই সময় নকশালবাড়ি আন্দোলন, কৃষক হত্যা, ভারত-চিন সম্পর্কের অবনতি-সমাজে যেভাবে এর প্রভাব পড়েছিল, লেখকের তা দৃষ্টি এড়ায়নি। সাহিত্য সমাজের দর্পণ আর কবি-সাহিত্যিকেরা তাঁদের সাহিত্যকর্মে সমকালের প্রতিফলন ঘটাবেন, এটাই স্বাভাবিক। কবি জয় গোস্বামীও এর ব্যতিক্রমী নন। নানান সামাজিক সংকটের ছবি বারবার তাঁর কবিতায় ধরা পড়েছে। পাঠ্য কবিতাটির মধ্যে একদিকে যেমন দেখা গেছে ক্রোধ, আত্ম-অবক্ষয়ের যন্ত্রণা, আর অন্যদিকে তেমন ফুটে উঠেছে অনন্ত প্রহরজুড়ে অপেক্ষারত একদল মানুষের কথা।

কবিতাটির মধ্যে যে তীব্র যন্ত্রণার গল্প আছে, তা কবি কথকের মুখ দিয়ে কথকতার ঢঙে বলিয়ে নিয়েছেন। নিত্য অভাব-অনটনের মধ্য দিয়ে অর্ধাহার-অনাহারে তাদের দিন কাটে। প্রতিদিন বাজারও হয় না, তার ওপর লেগে থাকে অসুখ। এইভাবে ধারদেনা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে সাধারণ ভাতকাপড়ে কোনোভাবে তাদের দিন কেটে যায়। এভাবেই জীবনযন্ত্রণাকে দূরে সরিয়ে রাখতে তারা গঞ্জিকা সেবনের মধ্যে ডুব দেয়। দিশেহারা এই যুবকেরা যেন স্বপ্নভঙ্গের মধ্যেও নতুন করে স্বপ্ন দেখে।

তাই যেদিন হাতে পয়সা আসে সেদিন যেমন মাত্রাছাড়া বাজার করে, তেমনি মনের দোলাচল সঙ্গে করেই গোলাপচারা কিনে ফেলে। কারণ একটা প্রশ্ন তাদের মনে ঘুরপাক খায়-তাদের অন্নসংকট কি কোনোদিন দূর হবে? ঠিক একই সংশয় ফুটে ওঠে গোলাপ গাছে কি ফুল হবেই? যদিও মানুষ বাঁচতে ভালোবাসে, সে শুকনো ভাতে সামান্য লবণের চাহিদা নিয়েই সমস্যার সমাধান খোঁজে! সময় বদলায়, সমাজ পালটায়, কিন্তু সমস্ত মানুষের পাতে নুনের বন্দোবস্ত হয় না। সেটুকু যেন অধরাই থেকে যায়। তবে মানুষের খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার সোচ্চার দাবিটুকু মিথ্যে হয়ে যায় না।

আরও পড়ুন – ছাত্রজীবন – মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top