ডাইনি-নিধন কী? কীভাবে ডাইনি-নিধন করা হত

ডাইনি-নিধন কী? কীভাবে ডাইনি-নিধন করা হত

ডাইনি-নিধন কী? কীভাবে ডাইনি-নিধন করা হত
ডাইনি-নিধন কী? কীভাবে ডাইনি-নিধন করা হত

ডাইনি-নিধন

ডাইনি-নিধন (Witch-Hunt) ছিল একটি জটিল এবং নৃশংস প্রক্রিয়া, যা মূলত ধর্মীয় কুসংস্কার, সামাজিক অস্থিরতা এবং লিঙ্গবৈষম্যের ভিত্তিতে পরিচালিত হত। ডাইনি-নিধন প্রক্রিয়ায় ডাইনি হিসেবে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের নানাভাবে অত্যাচার ও নির্যাতন করা হত। এমনকি মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত দেওয়া হত। এই প্রক্রিয়াটি বেশ কয়েকটি ধাপে বিভক্ত ছিল- ডাইনি পরীক্ষা, ডাইনি বিচার, শাস্তিপ্রদান ইত্যাদি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, পঞ্চদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে সপ্তদশ শতকের শেষভাগ পর্যন্ত সময়কালে যতজনকে ডাইনি সন্দেহে মেরে ফেলা হয়েছে, তাদের পাঁচভাগের চারভাগই ছিল স্ত্রীলোক।

ডাইনি নিধনের প্রক্রিয়াসমূহ

ডাইনি-নিধনের ক্ষেত্রে কতকগুলি প্রক্রিয়া লক্ষ করা যায়, যেমন-

(1)  ডাইনি সন্দেহ বা অভিযোগ: ডাইনি-নিধনের প্রথম ধাপ ছিল কোনও ব্যক্তিকে, বিশেষত নারীকে ডাইনি হিসেবে সন্দেহ করা। প্রতিবেশী বা সমাজের অন্য কোনও ব্যক্তি প্রতিযোগিতা, ব্যক্তিগত শত্রুতা, কিংবা পারিবারিক দ্বন্দ্বের কারণে কাউকে ডাইনি হিসেবে অভিযুক্ত করত।

(2) ডাইনি পরীক্ষা: সন্দেহজনক ব্যক্তিটি ডাইনি কিনা, তা প্রমাণ করার জন্য বিভিন্ন পরীক্ষা-পদ্ধতির প্রচলন ছিল, যেমন-

  • জল গেলানো: অভিযুক্ত ব্যক্তিকে চিৎ করে শুইয়ে তাকে জল গেলানো হত। এই সময় যদি সে দমবন্ধ হয়ে মারা না যায়, তাহলে তার অপরাধ সত্য বলে প্রমাণিত হত এবং তারপর তাকে নানাভাবে শাস্তি দেওয়া হত।
  • জলে ফেলে দেওয়া: অভিযুক্ত ব্যক্তির ডান হাতের সঙ্গে বাঁ-পা এবং বাঁ-হাতের সঙ্গে ডান পা গুণ চিহ্নের মতো বিপরীতভাবে বেঁধে দেওয়া হত। এরপর তাকে একটি জলাশয়ে চিৎ করে ফেলে দেওয়া হত। যদি সে তলিয়ে না যায়, তাহলে তাকে অপরাধী সাব্যস্ত করে শাস্তি প্রদান করা হত।
  • ওজন করা: ডাইনি নির্ধারণের আরও একটি পদ্ধতি হল- গির্জায় সংরক্ষিত এক বিরাটাকার বাইবেল গ্রন্থ দিয়ে ডাইনি সন্দেহে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে দাঁড়িপাল্লায় ওজন করা। গ্রন্থের চেয়ে ওই ব্যক্তির ওজন কম হলে তাকে নির্দোষ বলে মুক্তি দেওয়া হত। আর বেশি ওজন হলে তাকে কঠোর নির্যাতনের শিকার হতে হত। 
  • সূচ বিদ্ধ করা: ডাইনি সন্দেহে অভিযুক্তের শরীরের বিশেষ অংশে সূচ বা কোনও ধারালো বস্তু দিয়ে বিদ্ধ করা হত। এই সময় সেই ব্যক্তিটির কোনও ব্যথা অনুভূত না হলে বা রক্তক্ষরণ না হলে তাকে ডাইনি হিসেবে নির্যাতন করা হত। 

(3) ডাইনি বিচার: ডাইনিদের উপযুক্ত শাস্তি দেওয়ার জন্য উত্তর ইউরোপে যাজকীয় বিচারসভা (Papal Inquisition) প্রতিষ্ঠিত হয়। ডাইনি বিচার (Witch Trial) ও নিধনকার্যে এই বিচারসভার সঙ্গে যুক্ত থাকতেন একজন প্রধান বিচারক, কয়েকজন বিচারক, কিছু অনুসন্ধানকারী, নিগ্রহকারী প্রমুখ। পোপ চতুর্থ ইনোসেন্ট বিচারকদের ধর্মীয় আইনবলে ডাইনি হিসেবে সাব্যস্ত ব্যক্তিদের মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করার। ক্ষমতা প্রদান করেন। শাস্তিযোগ্য অপরাধের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল-গোপন ডাইনিসভা করা, শয়তানকে আহ্বান করা, শিশুবলি দেওয়া, নরমাংস খাওয়া ইত্যাদি। পোপ চতুর্থ ইনোসেন্ট তাঁর নির্দেশনামায় (Papal Bull) বলেন ডাইনিরা হল খ্রিস্ট ধর্মবিরোধী, ঈশ্বরের বিরুদ্ধাচারী, শয়তানের সঙ্গে আঁতাতকারী এক জঘন্য অপরাধী। সুতরাং তাদের চরমতম শাস্তিই প্রাপ্য। এর পরেই যাজক শ্রেণি পূর্ণ উদ্যমে ডাইনি-নিধনে নেমে পড়েন।

(4) শাস্তিপ্রদান: সারা ইউরোপ জুড়ে ধর্মের চাদরের আড়ালে Witch- Hunt-এর নামে শুরু হয় অবর্ণনীয় বর্বরতা এবং হত্যালীলা।

(a) ডাইনিদের সমস্ত প্রকার অপরাধের শাস্তি ছিল নৃশংস নির্যাতন। (b) ডাইনি- নিধনে প্রাচীন কালে এক ধরনের যন্ত্রের ব্যবহার করা হত। এক সুতীক্ষ্ণ যন্ত্র ডাইনির বুকে বিঁধিয়ে দেওয়া হত।

(c) বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ডাইনিদের আগুনে পুড়িয়ে মারার কথা জানা যায়। (d)  কিছু অঞ্চলে ডাইনিদের পাথর মেরেও হত্যা করা হত। ডাইনিদের বিচারসভায় বিচারের নামে চলত প্রহসন। 

(5) মৃত্যুর পরবর্তী প্রক্রিয়া: ডাইনিদের নৃশংসভাবে হত্যা করার পর  তাদের দেহ আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হত। মৃত্যুর পরবর্তীকালেও অভিযুক্তের পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের চরম লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়েছিল। ডাইনি-নিধন মানব ইতিহাসের একটি মর্মান্তিক অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত। পরিসংখ্যানের ফলে দেখা গেছে যে, সেই সময় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিচারের নামে প্রহসনে সবচেয়ে বেশি নিপীড়িত হত মহিলারাই।

আরও পড়ুন – ছাত্রজীবন – মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top