ডাইনিবিদ্যায় পুরুষদের তুলনায় নারীদের প্রাধান্যের কারণগুলি কী ছিল
অথবা, ডাইনি বিদ্যাচর্চায় নারীদের প্রাধান্য বিষয়ে সমাজবিজ্ঞানীদের মতামতগুলি আলোচনা
করো

সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই দেখা যায় যে, নারী বা পুরুষ উভয়ই ডাইনি হতে পারত। তবে ডাইনিবিদ্যা সংক্রান্ত বিভিন্ন পুথিপত্র ও অন্যান্য উপাদান থেকে জানা যায় অতিমানবিক ক্ষমতা নিয়ে যারা চর্চা করত, তাদের ৮০ শতাংশই ছিল মহিলা। ডাইনিবিদ্যায় নারীদের এই প্রাধান্য বিষয়ে সমাজবিজ্ঞানীরা নানান গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
ডাইনি বিদ্যাচর্চায় নারীদের প্রাধান্যের কারণসমূহ
(1) মাতৃতান্ত্রিক সমাজ: আদিম সভ্যতার যে সময়ে ডাইনিবিদ্যার চর্চা শুরু হয়, সেই সময়ের সমাজ ছিল মাতৃতান্ত্রিক (Matriarchy)। সমাজের সবক্ষেত্রেই তখন নারীদের প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়। নিজের নিজের গোষ্ঠীর ভালোমন্দ, মঙ্গল-অমঙ্গলের দায়িত্বও ছিল নারীদের উপর। তখন প্রকৃতির প্রতিকূল পরিস্থিতিতে অনেক মানুষের জীবনহানি হত। তারা প্রাকৃতিক শক্তিকে জয় করে গোষ্ঠীর মানুষের জীবনকে নিরাপদ করার জন্য অলৌকিক ডাইনিবিদ্যার চর্চা করত। প্রাকৃতিক শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করার সাধনায় নিমগ্ন গোষ্ঠীর মঙ্গলসাধনের উদ্দেশ্যেই থাকত নারীরা।
(2) খাদ্যসংগ্রহ এবং শিকারি পুরুষের সাফল্যকামনা: খাদ্যসংগ্রহই ছিল আদিম গুহাবাসী মানুষের প্রধান জীবিকা। নারীরা পরিবার বা গোষ্ঠীর শিশু ও বৃদ্ধদের দেখাশোনা করত আর পুরুষরা খাদ্যের অনুসন্ধানে ঘুরে বেড়াত, শিকারে যেত। অনেকসময় তারা হিংস্র জীবজন্তুর কিংবা অন্য গোষ্ঠীর শত্রুদের সম্মুখীন হওয়ার ফলে আহত বা নিহত হত। এর থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পুরুষরা যখন শিকারে যেত, তখন নারীরা নানারকম আচার-অনুষ্ঠান, জাদু ও তুকতাক করে খাদ্যসংগ্রহে সাফল্য ও শিকারির নিরাপদ প্রত্যাবর্তন কামনা করত।
(3) গোষ্ঠীর মঙ্গলকামনা: মাতৃতান্ত্রিক সমাজে গোষ্ঠীর মঙ্গলের জন্য নারীরা প্রাকৃতিক শক্তিকে সন্তুষ্ট করার লক্ষ্যে বিভিন্ন মূর্তি প্রতিষ্ঠা, মন্ত্রতন্ত্র ও বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান পালন করত। বিভিন্ন নামে বিভিন্ন দেবদেবীর কল্পনা করে আদিম মানুষ গাছ ও পাথরে দেবতার আরাধনা করত।
(4) রাতে ডাইনিচর্চা: ডাইনিবিদ্যা চর্চার সঙ্গে নারীদের সম্পর্ক অতি ঘনিষ্ঠ। বলা হয়, নারীরা নাকি রাতে ডাইনিবিদ্যার চর্চা করত। ঐতিহাসিকরা এর ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন যে, দিনের বেলা নারীরা নানারকম সাংসারিক কাজে নিযুক্ত থাকত। পুরুষরা সারাদিনের পরিশ্রমের পর যখন রাতে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে যেত, তখন নারীরা প্রকৃতির জগতের ঝড়-বৃষ্টি, জন্মমৃত্যু ইত্যাদি রহস্য নিয়ে চিন্তায় মগ্ন হত।
(5) অশুভ শক্তির আরাধনা: আদিম মানুষ প্রকৃতির সমস্তরকম অশুভ শক্তির প্রকোপ থেকে রক্ষা পাওয়ার উদ্দেশ্যে তাকে সন্তুষ্ট ও নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেছে। আসলে গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে বলা যায় যে, ভয় থেকেই ডাইনিবিদ্যার উদ্ভব হয়েছে। যে দেবতা যত বেশি ভয়ংকর, সেই দেবতার প্রতি ডাইনিদের আকর্ষণ তত বেশি।
(6) ধর্মীয় ও সামাজিক নিপীড়ন: পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীশক্তির প্রতি অবিশ্বাস ও সামাজিক নিপীড়নের কারণে নারীরা ডাইনিবিদ্যার সঙ্গে বেশি করে যুক্ত হয়েছে বলে অনেক সমাজবিজ্ঞানী মনে করেন। কিছু কিছু ধর্মে নারীদের পাপের উৎস বা প্রলোভনের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যা নারীদের ডাইনিবিদ্যার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
(7) প্রজনন ও প্রাকৃতিক চক্র: নারীদের প্রজনন ক্ষমতা এবং তাদের শরীরের প্রাকৃতিক চক্রের কারণে মনে করা হত, তাদের জন্মমৃত্যু নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা রয়েছে এবং তারা প্রাকৃতিক শক্তির সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। এই কারণেই নারীদের ডাইনি বিদ্যাচর্চায় প্রাধান্য রয়েছে।
(8) নারীশক্তির পুনবুদ্ধার : আধুনিক কালে অনেক নারীবাদী ডাইনি বিদ্যাচর্চাকে নারীশক্তির আধ্যাত্মিক স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করেছেন। বর্তমানে নারীরা অনেকক্ষেত্রেই নিজেদের শক্তি ও জ্ঞানকে পুনরুদ্ধার করার উপায় হিসেবে ডাইনি বিদ্যাচর্চা করে।
মন্তব্য
ডাইনি বিদ্যাচর্চায় নারীদের প্রাধান্যের একাধিক কারণ লক্ষণীয়। সমাজের বিভিন্ন স্তরে নারীদের ভূমিকা, আদিম যুগে মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা, অশুভ শক্তির ভয় ইত্যাদির ফলে নারীরা ডাইনিবিদ্যার সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত হয়েছে।