টীকা লেখো: ধর্ম ও বিজ্ঞান

টীকা লেখো: ধর্ম ও বিজ্ঞান

টীকা লেখো: ধর্ম ও বিজ্ঞান
টীকা লেখো: ধর্ম ও বিজ্ঞান

ধর্ম ও বিজ্ঞান

ধর্ম মানুষের ‘বিশ্বাস’। বিজ্ঞান আর বিশ্বাস স্বতন্ত্র। মানুষ যখন নিছক বিশ্বাসের স্তর থেকে উত্তীর্ণ হয়ে প্রকৃতির মধ্যে এই বিশ্বাসের অস্তিত্ব, সারবত্তা, যুক্তিসিদ্ধতার অনুসন্ধান করে তখন তা হয় বিজ্ঞানচর্চা। অর্থাৎ বিজ্ঞানে বিশ্বাস নয় বরং যুক্তিই মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করে। আর ধর্মভাবনার কেন্দ্রে আছে ঈশ্বরের অধিষ্ঠান। মহাকাশ, গ্রহনক্ষত্র, চন্দ্র-সূর্য সবকিছুতেই অদেখা ঈশ্বরের কর্তৃত্বের উপর প্রশ্নহীন বিশ্বাস ধর্মের অংশ। প্রাকৃতিক ঘটনাবলিও ঈশ্বরের নিয়ন্ত্রিত বা নির্দেশিত ইচ্ছার প্রকাশ বলে মনে করা হয়। ফ্রান্সিস বেকন-এর মতে, বিজ্ঞানের ও ধর্মের দুটি পৃথক ক্ষেত্র আছে। বিশ্বাসের মাধ্যমে নয়, পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে বিজ্ঞানচর্চা করা প্রয়োজন। পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকে ইউরোপে বিজ্ঞান ও ধর্মের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে। প্রাচীন গ্রিক ও রোমান ধ্রুপদি চিন্তাধারা ও জ্ঞানের পুনরুদ্ধার ধর্ম ও বিজ্ঞানের মধ্যে একটি সম্পর্ক সৃষ্টি করেছিল।

(1) আধুনিক যুগের ধর্ম: মানবতাবাদের উত্থানের প্রভাব পড়েছিল ধর্মে। যদিও মানবতাবাদ ধর্মবিরোধী ছিল না, কিন্তু মানবতাবাদ মানুষের সম্ভাবনা, স্বতন্ত্রতা ও ক্ষমতার উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করলে পোপ ও চার্চের প্রাধান্য হ্রাস পায়। নবজাগরণ পর্বের শেষের দিকে ধর্মসংস্কার আন্দোলন শুরু হলে ইউরোপে মধ্যযুগ থেকে প্রচলিত ধর্মীয় কর্তৃত্ববাদ শিথিল হয়ে পড়েছিল। খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্ট বিভাজন ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাসের উপর গুরুত্ব আরোপ করে।

(2) আধুনিক যুগের বিজ্ঞান: আধুনিক যুগের বিজ্ঞানীদের মধ্যে বিশ্বজগৎকে জানার ইচ্ছা ছিল প্রবল। প্রকৃতির বিভিন্ন অলৌকিক ঘটনা যুক্তি, পরীক্ষানিরীক্ষা ও গবেষণার মাধ্যমে জানার চেষ্টা করতে বিজ্ঞান ছিল সহায়ক। পাশ্চাত্য বিজ্ঞানচর্চার ভিত প্রস্তুতিতে বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল মধ্যযুগের বিশ্ববিদ্যালয়গুলি। নিকোলাস কোপারনিকাসের সৌরকেন্দ্রিক বিশ্বব্রষ্মাণ্ডের ধারণা, গ্যালিলিও গ্যালিলির আবিষ্কৃত মহাকাশ সম্পর্কিত নতুন নতুন তথ্য মধ্যযুগীয় ধর্মচিন্তার বিরোধী হলেও বিজ্ঞানচর্চার পথ প্রশস্ত করে।

(3) ধর্ম ও বিজ্ঞানের সম্পর্ক: আধুনিক যুগে ধর্ম ও বিজ্ঞানের মধ্যে সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত জটিল। নবজাগরণের যুগে মানবতাবাদী পণ্ডিতদের মধ্যে ধর্মীয় বিশ্বাস সম্পর্কে সংশয় দেখা দেয়। কেবল বিশ্বাসের স্তর অতিক্রম করে প্রাকৃতিক ঘটনাবলি এবং উপাদানগুলির উপর গভীর পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষানিরীক্ষা দ্বারা ঘটনার গতিপ্রকৃতি, উৎস ইত্যাদি নির্ধারণ করার প্রয়োজন অনুভূত হয়। ধর্ম ও বিজ্ঞানের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে আলোচনায় উভয়ের বিরোধের দৃষ্টান্তস্বরূপ কয়েকটি প্রয়োজনীয় তথ্যের উল্লেখ করা যায়। ক্যাথলিক ঈশ্বরবাদী গোষ্ঠী দেকার্তের দর্শনের বিরোধিতা করেছিলেন। এর কারণ হল, ক্যাথলিক ব্রহ্মবাদের ভিত্তি ছিল যে অ্যারিস্টটলীয় দর্শন, দেকার্তে তাকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখেছিলেন। আবার প্রোটেস্ট্যান্ট সংস্কারকগণও ক্যাথলিকদের পাশাপাশি নতুন মহাকাশ তত্ত্বকে স্বীকৃতি প্রদানে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। এমনকি মার্টিন লুথার, ক্যালভিনের মতো ব্যক্তিরাও কোপারনিকাসের মহাকাশ তত্ত্ব নিয়ে ব্যঙ্গ করতেন। আমেরিকান ঐতিহাসিক টি কে রব (TK Rabb)-এর মতে, বলা যায় অন্ততপক্ষে সপ্তদশ শতকের প্রথমদিকে বিজ্ঞান ও প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মতত্ত্বের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে পার্থক্য ছিল।

মূল্যায়ন

ফ্রান্সিস বেকন, রেনে দেকার্তে প্রমুখ বলেন যে, পর্যবেক্ষণ যদি বিজ্ঞানের মূলকথা হয়, তাহলে প্রাকৃতিক জগৎ সম্পর্কে পূর্ব নির্ধারিত তত্ত্ব বা ঈশ্বর নিয়ন্ত্রিত ধারণার কোনও মূল্য নেই। এইভাবে আধুনিক বিজ্ঞানে ধর্মবিশ্বাস ও বিজ্ঞানভাবনার মধ্যে একটা ভেদরেখা ক্রমশ স্পষ্ট হতে থাকে। এই ধর্মবিমুক্ত অনুসন্ধিৎসাই আধুনিক বিজ্ঞানের বৈশিষ্ট্য। ধর্মবিশ্বাস এবং আধুনিক পর্যবেক্ষণ মানসিকতার বিচ্ছেদই হল বিজ্ঞান বিপ্লবের বিশেষত্ব।

আরও পড়ুন – ছাত্রজীবন – মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top