ছাত্রজীবন – মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা

- ছাত্রজীবন অধ্যবসায়, আত্মপ্রত্যয়, জ্ঞানপিপাসা ও মনুষ্যত্ব অর্জনের সাধনা
- অধ্যয়নই ছাত্রজীবনের তপস্যা
- ছাত্রজীবন নিয়মশৃঙ্খলা ও সাধনার জীবন
- ছাত্রজীবন সেবা, ত্যাগ, দয়া, পরোপকার প্রভৃতি মানবিক গুণাবলির বিকাশসাধনের সময়
- ছাত্রজীবনে অর্জিত শিক্ষা, আদর্শ ভবিষ্যৎ জীবনের পাথেয়
- বিদ্যাচর্চার সঙ্গে সঙ্গে শরীরচর্চাও ছাত্রজীবনে আবশ্যক। সুস্থ শরীর, সুস্থ মনের জন্য প্রয়োজনীয়
“আমরা শক্তি আমরা বল
আমরা ছাত্রদল।”-নজরুল ইসলাম।
অধ্যয়নই হল ছাত্রদের একমাত্র তপস্যা। এই বাণীটি ঠিক কবে কোথায় প্রথম উচ্চারিত হয়েছিল, তা ঠিক জানা নেই। কিন্তু আমরা এই উপদেশটি বছরের পর বছর ধরে অনুসরণ করে আসছি।
পড়াশোনা করছি বলে আর কোনো দায়দায়িত্ব পালন করব না, সব রকম সমস্যার দিকে পিছন ফিরে বসে থাকব-এটা কখনও সম্ভব হতে পারে না। আমরা কেউই তপোবনের শিক্ষার্থী নই। আমরা সমাজে বাস করছি। সামাজিক সমস্যা সম্পর্কে আমরা সচেতন। আমরা জানি- “নগর পুড়িলে দেবালয় কি এড়ায়?”
সুতরাং দেবালয়কে বাঁচাতে হলে আমাদের আগুনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। এই ব্যবস্থা যদি নিতে হয়, তাহলে ছাত্র হলেও কিন্তু সামাজিক দায়িত্ব নিতেই হয়। শুধু পড়াশোনায় চলবে না।
কেবল ভালো ছাত্র নয়, একজন সুনাগরিক হতে হলে বিশেষ কয়েকটি সামাজিক দায়িত্ব এই ছাত্র-অবস্থা থেকেই আমাদের পালন করা দরকার। এই দায়িত্বগুলির ভিতর প্রথম ও প্রধান হল পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্নতা রক্ষা। বিদ্যালয়ের পরিবেশকে পরিচ্ছন্ন রাখা খুবই জরুরি। পল্লিগ্রামের স্কুল বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই থাকে জঙ্গলে ভরা। স্কুলের মাঠ এবং ঘরবাড়ির আনাচেকানাচে থাকে নানা ধরনের নোংরা জিনিসে ভরতি। ছাত্ররা যদি কারও সাহায্যের কথা না-ভেবে নিজেরাই এই নোংরা জিনিস পরিষ্কারের দায়িত্ব তুলে নেয় তাহলে স্কুল প্রাঙ্গণ পরিষ্কার হয়। পরিচ্ছন্নতার এই পাঠ পরে জীবনের কাজে লাগে।
সুভাষচন্দ্র বসুর জীবনী পাঠ থেকে জানা যায়, তিনি ছাত্রাবস্থা থেকেই রোগীর সেবা ও দরিদ্রদের সাহায্য ইত্যাদি কাজ নিয়মিত করতেন। এই ধরনের কাজ খুব ছেলেবেলা থেকেই শিখতে হয়, সেবা অতি পবিত্র ধর্ম। যাকে সেবা করা হয়, সে হয়তো অনেক উপকৃত হয়। কিন্তু যে সেবক, সেও কিন্তু কম উপকৃত হন না। ছেলেবেলা থেকেই তার মন গড়ে ওঠে একটি নিঃস্বার্থ সেবার আদর্শে। এই আদর্শ পরবর্তী জীবনে খুবই কাজে লাগে। সমাজসেবার কাজে ছাত্রসমাজের দায়িত্ব কতখানি?-এ প্রশ্ন আমাদের মনে জাগে। ছাত্রাবস্থায় মন থাকে সবুজ ও সতেজ, এই সময় তারা আর্ত-পীড়িতের ব্যথায় ব্যথিত হয়ে ওঠে-তাই মনপ্রাণ সমর্পণ করে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে সমাজসেবার কাজে-আত্মত্যাগের মূর্ত ও জ্বলন্ত প্রেরণা নিয়ে। ছাত্রদের মূল কর্তব্য অধ্যয়ন হলেও সমাজ তার কাছে প্রত্যাশা করে অনেক কিছু-সেগুলি হল পারস্পরিক প্রীতি ও সৌহার্দ্যের প্রতিষ্ঠা, সহানুভূতি ও সমবেদনার প্রেরণা। দুঃস্থ, আর্ত মানুষের জন্যে সহানুভূতি ও সমবেদনার বশে ছাত্রদের তাই মাঝে মাঝে অংশগ্রহণ করতে হয় নানাবিধ সেবামূলক কাজে।
সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজন স্বাস্থ্যচর্চা, ব্যায়াম। প্রতিদিন নিয়মিত সময়ে কিছুক্ষণ ব্যায়াম শরীরকে নীরোগ রাখে, নির্মল রাখে। যোগব্যায়াম, অ্যাথলিটিক্স, সাঁতার প্রভৃতি সব রকম প্রক্রিয়াতেই স্বাস্থ্যচর্চা করা যায়। দেহের স্বাস্থ্যের সঙ্গে মনের স্বাস্থ্যও সুসংগঠিত হয় খেলার নিয়মিত চর্চায়। খেলার এই গুরুত্বকে অনুধাবন করেই এর নাম দেওয়া হয়েছে Physical Education। এই শারীরশিক্ষা আমাদের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পাঠ্যক্রমে অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে।
বড়ো বড়ো দেশ পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছে কঠিন শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা অনুসরণের ফলে। কোন্ সময় কোন্ বিষয় পাঠ অনুসরণ করা হবে, কোন্ বিষয়ে পাঠ গুরুত্বপূর্ণ-তা মনে রেখে ঠিক করা হল এক ধরনের শৃঙ্খলা। প্রাচীন কালে ছাত্ররা গুরুগৃহে বিদ্যালাভ করত কঠোর নিয়মশৃঙ্খলার মধ্যে থেকে। শৃঙ্খলা মানুষের সমস্ত প্রয়াসকে একটা নিয়মের বন্ধনে আবদ্ধ রাখে।
ছাত্রছাত্রীদের যে বিষয়ে সচেতন হওয়া দরকার, তা হল নিজেকে একজন দায়িত্ববান নাগরিক হিসেবে ভবিষ্যতের জন্য গড়ে তোলা। মনীষীদের ক্ষমা, ত্যাগ, তিতিক্ষা-এগুলি আমাদের জীবনে রূপায়িত করার দায়িত্ব আমাদেরই নিতে হবে, না-হলে সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়ে যাবে।