ইতালীয় রেনেসাঁ বা নবজাগরণের সীমাবদ্ধতাগুলি উল্লেখ করো

ভূমিকা
ইতালীয় রেনেসাঁ চতুর্দশ থেকে ষোড়শ শতক পর্যন্ত ইটালি তথা সমগ্র ইউরোপে জীবন, দর্শন, সাহিত্য, ধর্ম, শিল্পকলা, জ্ঞান-বিজ্ঞান ধর্ম সবক্ষেত্রেই পরিবর্তনের ছাপ রেখেছিল যা মধ্যযুগীয় রক্ষণশীলতার পরিবেশকে আধুনিক পৃথিবীর উদার পরিবেশে পরিণত করেছিল। তবে সাম্প্রতিক কিছু গবেষণার ভিত্তিতে, এই নবজাগরণের উন্নতিকামী দিকগুলির সঙ্গে সঙ্গে কিছু সীমাবদ্ধতার কথাও উঠে এসেছে।
(1) উচ্চশ্রেণিকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা: নবজাগরণের যুগে প্রাচীন ধ্রুপদি সাহিত্যের চর্চা ব্যাপক প্রসারিত হয়। মানবতাবাদীরা অনেক শিক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন যেখানে পাঠ্যক্রম নির্ধারিত হত উচ্চশ্রেণির (elite) কথা মাথায় রেখে। কোনো বিশেষ বিষয়ভিত্তিক শিক্ষা নয়-শিক্ষা ছিল অত্যন্ত বিস্তৃত-বিশাল জ্ঞানের চর্চাভিত্তিক; বাস্তবে সাধারণ পরিবারের মানুষের জীবনধারণের জন্য নীতিবিজ্ঞান, ধর্মজ্ঞান, ধ্রুপদি সাহিত্য, আইনের পরিবর্তন, নগরপ্রশাসন, লাতিন ভাষা ও সাহিত্য ইত্যাদি এত কিছু শেখার প্রয়োজন সকলের ছিল না। এই পাঠ্যক্রম সেইসব সম্ভ্রান্ত উচ্চশ্রেণির পরিবারগুলির জন্য উপযুক্ত ছিল যারা তাদের সন্তানদের ভবিষ্যতে প্রশাসন, বাণিজ্য, রাজনীতি ইত্যাদিতে নেতৃত্বের স্থানে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইতেন।
(2) ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নগররাষ্ট্রের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা: চতুর্দশ শতকের ইটালিতে একশোরও বেশি নগররাষ্ট্রের অস্তিত্ব ছিল। সেগুলি কোনো কেন্দ্রীয় শক্তির বদলে নগরগুলির নিজস্ব অভিজাততান্ত্রিক (বণিকগোষ্ঠী পরিচালিত) কাঠামো দ্বারা শাসিত হত। এই নগররাষ্ট্রগুলির মধ্যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও সংঘর্ষ লেগেই থাকত। নগরবাসীরা নিজেদের সুরক্ষার জন্য ক্রমে সমরনায়কদের ওপর নির্ভর করতে থাকেন। এই সমরনায়করা অনেকেই একনায়কতান্ত্রিক শাসন চালাতে থাকেন যা জনগণের সকল শ্রেণির পক্ষে মঙ্গলজনক ছিল না। যেমন-ফ্লোরেন্সে মেদিচি পরিবারের শাসন ছিল রাজতন্ত্রের নামান্তরমাত্র।
(3) সমাজে শ্রেণিবিভেদ বৃদ্ধি: রেনেসাঁ প্রসূত শিল্প, সংস্কৃতি ও বৌদ্ধিক অগ্রগতি ছিল শুধুমাত্র অভিজাত, যাজক ও উদীয়মান বণিকগোষ্ঠীর জন্য। কৃষক, শ্রমিক ও সাধারণ জনগণের মধ্যে অর্থনৈতিক- রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক উন্নয়নের সুফল খুব কমই পৌঁছেছিল। এর ফলে চতুর্দশ শতকে ইটালির বিভিন্ন শহরে শ্রেণিগত ও সামাজিক অবস্থানগত পার্থক্য এত বৃদ্ধি পায় যে দরিদ্র জনসাধারণ ও সম্পন্ন বণিকদের মধ্যে সংঘাতের ঘটনা ঘটতে থাকে। ১৩৭৮ খ্রিস্টাব্দে ফ্লোরেন্সে এই সংক্রান্ত বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল।
(4) নারী সমাজের প্রতি অবহেলা: নবজাগরণের যুগে সমাজকে আধুনিকতার দিকে এগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন মানবতাবাদীরা। কিন্তু সমাজে নারীর স্থান নিয়ে অদ্ভুতভাবে তারা রক্ষণশীলতাকে অতিক্রম করতে পারেননি। রেনেসাঁর আতুরঘর ফ্লোরেন্সসহ সমকালীন সমাজে নারীকে দুর্বল লিঙ্গ, পুরুষের দ্বারা পরিচালিত ও প্রতিপালিত, সন্তান ও সংসারের রক্ষণাবেক্ষণকারিণীর বাইরে আর কিছু ভাবা হত না। জ্ঞানচর্চা বা অন্য কোনো ক্ষেত্রে কতিপয় সম্ভ্রান্ত পরিবারের নারীগণ, যেমন-ইসাবেলা ডি এস্তে, ভেরোনিকা গ্যামবারা প্রমুখ যুক্ত থাকলেও সাধারণ নারীসমাজ গৃহকোণেই আবদ্ধ ছিল।
(5) পরিবেশগত অবনমন: রেনেসাঁর ফলে ক্রমাগত নগরায়ণ, শিল্পস্থাপন ইত্যাদি উদ্ভিদসহ প্রাকৃতিক সম্পদের ও জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্যকে বিনষ্ট করতে থাকে।
(6) সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের আভাস: নবজাগরণ মানুষের অজানাকে জানার ইচ্ছা বাড়িয়ে দেয়। দুঃসাহসী নাবিকরা অসীম সমুদ্র পাড়ি দিয়ে নতুন নতুন ভূখণ্ড আবিষ্কার করেন। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ নতুন আবিষ্কৃত অঞ্চল দখল করে উপনিবেশ স্থাপন করে। এই প্রক্রিয়ায় অসংখ্য আঞ্চলিক অধিবাসী ও সভ্যতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
মূল্যায়ন
প্রতিটি ঘটে যাওয়া ঘটনারই ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক থাকে। ইটালির রেনেসাঁর কিছু সীমাবদ্ধতা থাকলেও এর যুগান্তর সৃষ্টিকারী বৈশিষ্ট্যগুলিকে অস্বীকার করা যায় না।