ইউরোপে ধর্মসংস্কার আন্দোলনের প্রেক্ষাপট বা কারণগুলি উল্লেখ করো

ভূমিকা
মধ্যযুগে খ্রিস্টান ধর্মে পোপতন্ত্রের কর্তৃত্ব ছিল সর্বময় ও চূড়ান্ত। যাজকদের ধর্মীয় কর্তৃত্ব ও নির্দেশ লঙ্ঘন করা ছিল খ্রিস্টানদের পক্ষে অসম্ভব। নবজাগরণ এবং বিজ্ঞানের আবিষ্কার মানুষের চেতনা জাগ্রত করে। মুদ্রিত বাইবেল পাঠ করে সাধারণ খ্রিস্টভক্তরা ধর্মের মূল বাণী অনুধাবন করতে সক্ষম হন। এই প্রেক্ষাপটে খ্রিস্টধর্মের ভ্রান্ত ধারণা এবং যাজকদের অনাচার ভেঙে দেওয়ার লক্ষ্যে প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়। সংস্কারবাদী পণ্ডিত, দার্শনিক প্রমুখ সদ্ধর্ম পুনঃপ্রতিষ্ঠার ডাক দেন। প্রচলিত ধর্মীয় অনাচার বাতিল করে সদ্ধর্ম পুনরুদ্ধারের এই প্রয়াস ‘ধর্মসংস্কার আন্দোলন’ (Reformation Movement) নামে অভিহিত হয়।
ধর্মসংস্কারের কারণ
ধর্মসংস্কার আন্দোলনের একাধিক কারণ ছিল-
(1) পোপের প্রাধান্য: সমগ্র মধ্যযুগ জুড়ে খ্রিস্টান জগতের সর্বশক্তিমান ব্যক্তি ছিলেন পোপ। তিনি নিজেকে ‘ঈশ্বরের প্রতিনিধি’ বলে মনে করতেন। এমনকি ইউরোপের যে-কোনো রাষ্ট্রে সম্রাটের অভিষেকের ব্যাপারেও পোপের স্বীকৃতি বাধ্যতামূলক ছিল। আইন প্রণয়নেও তাঁর মতামত নিতে রাজারা বাধ্য ছিলেন। রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে পোপের এই সীমাহীন আধিপত্য ইউরোপের রাজাদের পোপবিরোধী করে তোলে।
(2) চার্চের নৈতিক অধঃপতন: চার্চের যাজক ও মঠের সন্ন্যাসীদের জীবনে অনাচার ও নীতিহীনতা ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। পোপ ও যাজকরা ভোগবিলাস, আমোদ-প্রমোদে অর্থ ব্যয় করত। চারিত্রিক সংযমের বদলে অনৈতিক কার্যকলাপ ও ব্যাভিচারে মগ্ন থাকত। ধর্মগুরুদের এই নৈতিক অধঃপতন সাধারণ মানুষকেও বীতশ্রদ্ধ করে তুলেছিল।
(3) চার্চের আর্থিক শোষণ ও দুর্নীতি: এই সময় চার্চগুলি সাধারণ মানুষের কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের বাধ্যতামূলক কর আদায় করত। টাইথ বা ধর্মকর, অ্যানেট বা বাৎসরিক কর, জন্মকর, মৃত্যুকর ইত্যাদির দ্বারা পোপ ও যাজকরা সাধারণ মানুষদের নানাভাবে শোষণ করত। ৪ এমনকি পোপ ও বিশপ নির্বাচনেও বিপুল পরিমাণ ঘুষ লেনদেন হত। এইসকল দুর্নীতি মানুষজনকে চার্চের প্রতি বিক্ষুব্ধ করে তোলে।
(4) ইনডালজেন্স বিক্রি: পোপের নির্দেশে খ্রিস্টান চার্চ ইনডালজেন্স বা ক্ষমাপত্র নামে একরকম কাগজ বিক্রি করতে থাকে। এটি ক্রয় করলে সাধারণ মানুষের যাবতীয় পাপ ধুয়ে যাবে বলে প্রচার করা হয়। এইভাবে সাধারণ মানুষকে ভাঁওতা দিয়ে চার্চ অনৈতিকভাবে অর্থ আদায় করলে এর বিরুদ্ধে জনমত গড়ে ওঠে।
(5) মুদ্রণ বিপ্লব: ইউরোপে মুদ্রণ বিপ্লবের ফলে বিভিন্ন ভাষায় বাইবেল অনুদিত হয়। ফলে সাধারণ মানুষের কাছে খ্রিস্টান ধর্মের মূল তত্ত্ব পৌঁছে যায়। সাধারণ খ্রিস্টানরা বুঝতে পারে যে, এতদিন যাবৎ – পোপ, যাজকরা নিজেদের স্বার্থে তাদের ভুল বুঝিয়ে এসেছে। এই ধর্মীয় আদর্শের বিচ্যুতি ধর্মসংস্কার আন্দোলনের প্রেক্ষাপট রচনা করে।
(6) ধর্মসংস্কারকদের ভূমিকা: চতুর্দশ শতক থেকেই জন ওয়াইক্লিফ, জন হাস, ইরাসমাস প্রমুখ সংস্কারকগণ প্রচলিত ক্যাথোলিক ধর্মের রীতিনীতির বিরোধিতা ও সংস্কারের কথা বলেছিলেন। তাঁদেরই উত্তরসূরি মার্টিন লুথার ও তাঁর অনুগামী জন ক্যালভিন প্রমুখ ষোড়শ শতকে ক্যাথোলিক ধর্মের অনাচার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। এইভাবে ধর্মসংস্কার আন্দোলনের পথ প্রশস্ত হয়।
মূল্যায়ন
পঞ্চদশ শতকে ইউরোপের নবজাগরণের আবহাওয়ায় যুক্তিবাদী চেতনা, মানবতাবাদী ভাবধারা ও বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা ধর্মীয় প্রাধান্য ও অনাচারকে উপড়ে ফেলার সহায়ক হয়েছিল।