অ্যালকেমি কীভাবে আধুনিক রসায়ন হয়ে ওঠে

সাধারণ বা নিকৃষ্ট বস্তু থেকে মূল্যবান ধাতু (সোনা, রুপো) তৈরির বিকৃত পদ্ধতি বা বিদ্যাই হল অ্যালকেমি বা অপরসায়ন। এরমধ্যে একধরনের রহস্যবাদ বা গোপন প্রক্রিয়া ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিল, অন্যদিকে আধুনিক রসায়নবিদ্যায় পরীক্ষানিরীক্ষা ও গবেষণালব্ধ জ্ঞানকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। অপরসায়নবিদরা যে রসায়নচর্চার সূত্রপাত করেন তার সংস্কারের মাধ্যমেই আধুনিক রসায়নের উৎপত্তি ঘটে। তাই অপরসায়নকে আধুনিক বিজ্ঞানের বীক্ষণাগার বা Laboratory বলা হয়।
অ্যালকেমি থেকে আধুনিক রসায়নে উত্তরণ
(1) কিমিয়া/কেমিয়াবিদ্যার সূচনা: খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকে লেখা চৈনিক গ্রন্থ শি-চি (Shih-Chi)-তে কেমিয়াবিদ্যার উল্লেখ প্রথম পাওয়া যায়। খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে আলেকজান্দ্রিয়ায় কেমিয়াবিদ্যার চর্চা শুরু হয়। সেকালের বিখ্যাত কেমিয়াবিদ ছিলেন জনৈক ডিমোক্রিটাস (Democritus, আণবিক মতের উদ্দ্গাতা নন)। তাঁর লেখা Physica et Mystica গ্রিক ভাষায় লেখা অপরসায়ন বিষয়ক প্রথম গ্রন্থ।
(2) জোসিমোস-এর ভূমিকা: জোসিমোস (Zosimos of Panopolis) খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকে অপরসায়ন বিষয়ক ২৮ খণ্ডের বিশ্বকোশ রচনা করেন। তিনি বিভিন্ন রাসায়নিক প্রক্রিয়া, যেমন- দ্রবণ, পরিস্রাবণ, কেলাসন, উর্ধ্বপাতন, পাতন ইত্যাদির আলোচনার পাশাপাশি এই গ্রন্থে পারদ ও আর্সেনিকের প্রস্তুত প্রণালী বিষয়ে উল্লেখ করেছেন।
(3) গ্যালেন-এর ভূমিকা: গ্রিক ভেষজবিদ গ্যালেন (Galen, ১২৯-২১৬ খ্রিস্টাব্দ)-এর মতে, রাসায়নিক যৌগ দ্বারা রোগ নিরাময়ের পদ্ধতি উদ্ভাবন মানুষের দ্বারাই সম্ভব। তাঁর বিশ্বাস ছিল, দেহের অভ্যন্তরীণ ভারসাম্য বিঘ্নিত হলেই রোগের আক্রমণ ঘটে। প্রকৃতির মধ্যেই শুদ্ধ ও অশুদ্ধ সম্পদ বর্তমান। অশুদ্ধ বস্তু থেকে শুদ্ধ বস্তুকে উদ্ধার করে মানুষের কাজে লাগানোই রসায়নশাস্ত্রের কাজ।
(4) প্যারাসেলসাস-এর ভূমিকা: প্যারাসেলসাস (Paracelsus, ১৪৯৩- ১৫৪১ খ্রিস্টাব্দ) ছিলেন সুইস চিকিৎসক ও অ্যালকেমিস্ট। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, ধর্ম ও বিজ্ঞান অবিচ্ছেদ্য। তিনিই সম্ভবত প্রথম জিঙ্ক (দস্তা) মৌলটির আধুনিক নাম দেন। নিজের অজ্ঞাতসারেই হাইড্রোজেন গ্যাস প্রত্যক্ষ করেছিলেন তিনি। প্যারাসেলসাস মানুষের রোগের কারণ প্রসঙ্গে বলেন যে-জল, খাদ্যবস্তু এবং বাতাসের মাধ্যমে রোগজীবাণু মানুষকে আক্রমণ করে।
(5) জর্জিয়াস অ্যাগ্রিকোলার ভূমিকা: জর্জিয়াস অ্যাগ্রিকোলা (Georgius Agricola) খনিজ ভূবিদ্যা থেকে শুরু করে ধাতুবিদ্যা, গঠনগত ভূবিদ্যা এবং জীবাশ্মবিদ্যায় মৌলিক অবদান রেখেছিলেন। তাঁর দ্বাদশ খণ্ডে সমাপ্ত De Re Metallica গ্রন্থে খনি, খনিজশিল্প, ধাতু নিষ্কাশন সম্পর্কিত বিষয় থেকে শুরু করে ভূবিদ্যা, পূর্তবিদ্যা প্রভৃতি বিষয় আলোচিত হয়েছে।
(6) রবার্ট রয়েল-এর ভূমিকা: অ্যালকেমি এবং রসায়নবিদ্যা চর্চার একটা সেতুবন্ধন দেখা যায় ব্রিটিশ রসায়নবিদ রবার্ট বয়েল (Robert Boyle, ১৬২৭-১৬৯১ খ্রিস্টাব্দ)-এর গবেষণার মধ্যে। বিভিন্ন অপরসায়নবিদের রচনা পাঠ করে তিনি নিকৃষ্ট ধাতুকে মূল্যবান ধাতুতে রূপান্তরের পদ্ধতি আত্মগত করার চেষ্টা চালান। তিনিই প্রথম পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানচর্চা দ্বারা ধাতুর চরিত্র পরিবর্তনের রহস্য উদ্ধারের চেষ্টায় রত হয়েছিলেন। অর্থাৎ, রবার্ট বয়েলের কর্মধারায় অ্যালকেমিস্টদের জাদুবিদ্যা এবং আধুনিক রসায়নচর্চার পরীক্ষানিরীক্ষার ধারা দুইয়েরই সক্রিয়তা ছিল। তবে গুপ্তবিদ্যার অনুসন্ধানের কাজে গোপনীয়তা বা রহস্যময়তার রীতি বর্জন করে তিনি পরীক্ষালব্ধ জ্ঞান সমাজের সামনে প্রকাশ করতে দ্বিধা করেননি।
মূল্যায়ন
অপরসায়নবিদ্যার অবসান এবং আধুনিক রসায়নচর্চার সূচনা আধুনিক বিজ্ঞানচর্চার ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতক থেকেই রসায়নবিদ্যার নানান ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সাধিত হয়। সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতক নাগাদ হামফ্রে ডেভি (Humphry Davy), জন ডালটন (John Dalton), মেয়ো প্রমুখ বিজ্ঞানী রসায়নবিদ্যা চর্চায় গুরুত্বপূর্ণ স্বাক্ষর রেখেছিলেন। সবশেষে বলা যায়, ধর্মীয় অলৌকিকতা, রহস্যবাদ, গোপন প্রক্রিয়া ত্যাগ করে অ্যালকেমি যুক্তিবাদ, গবেষণা ও পরীক্ষানিরীক্ষার আশ্রয় নিলে এবং পুরোনো অনেক ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়। এভাবেই ধীরে ধীরে অ্যালকেমি থেকে আধুনিক রসায়নে উত্তরণের পথ প্রশস্ত হয়। Alchemy এবং Chemistry-কে আধুনিক বিজ্ঞানচর্চার ক্রমোচ্চস্তর অবশ্যই বলা যাবে না। তবে রসায়নচর্চার প্রাক্-পর্বে প্রকৃতির রাজ্যে বিভিন্ন পদার্থ ও যৌগের অস্তিত্বের অস্পষ্ট এবং অপরীক্ষিত ধারণা অ্যালকেমিস্টদের চিন্তাভাবনা থেকেই উঠে এসেছিল। নিকৃষ্ট ধাতুকে উৎকৃষ্ট ধাতু সোনাতে উন্নীত করার ভাবনা একধরনের কষ্টকল্পনাই ছিল। কিন্তু এমনতর কল্পনা ছাড়া রসায়নশাস্ত্রের উদ্ভব খুব সহজ হত না। ধাতু রূপান্তরের কাজে তাঁরা ব্যর্থ হয়েছিলেন একথা সত্য। কিন্তু ঐ ব্যর্থতা স্পষ্ট করেছিল যে, বিশ্বপ্রকৃতিতে বিভিন্ন পদার্থ নিজ নিজ গুণ ও বৈশিষ্ট্য দ্বারা একে অপরের থেকে স্বতন্ত্র। তাই গভীর পরীক্ষানিরীক্ষা দ্বারা ওই সকল পদার্থের গুণ আবিষ্কারের জন্য রসায়নশাস্ত্রের চর্চা জরুরি-এই সত্য অপরসায়নবিদরা স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন।